বাংলা ভাষা ও সাহিত্যর আত্মপরিচয় নিজের সভ্যতার ভিতর থেকে উদ্ভূত

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যর আত্মপরিচয়

বাংলার ইতিহাসের আত্মপরিচয় কেবল ইউরোপীয় কাঠামো নয়, বরং নিজের সভ্যতার ভিতর থেকে উদ্ভূত

ইতিহাস লেখা কেবল ঘটনাপঞ্জি রচনা নয়, বরং এক গভীর সাধনা। এটি এমন এক শিল্প, যেখানে অতীতকে বুঝতে হয়, আবার তার অন্তর্নিহিত শক্তি, সংঘাত, পক্ষপাত ও প্রেক্ষাপটকে সমালোচনামূলক দৃষ্টিতে দেখতে হয়। ইতিহাস কোনো নিরপেক্ষ আয়না নয়—যিনি লিখছেন, তাঁর মানসিকতা, সময়, প্রাপ্ত তথ্য ও সীমাবদ্ধতা—সব মিলেই ইতিহাসের রূপ নির্ধারিত হয়। তাই ইতিহাস মানে বহুস্তরীয় কাহিনি, যেখানে আলো-অন্ধকার, নায়ক-খলনায়ক, বিজয়-পরাজয় মিলেমিশে এক স্রোতের মতো বয়ে চলে।

আমেরিকার ইতিহাসচর্চা তার একটি দৃষ্টান্ত। ইউরোপীয় আগমনের আগে যে সমৃদ্ধ অ্যাজটেক, ইনকা কিংবা অসংখ্য আদিবাসী সভ্যতা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে টিকে ছিল, সেসবকে পরিকল্পিতভাবে আড়াল করা হয়েছে। উপনিবেশকারীরা নিজেদের আগমনকে বীরত্বগাথা বানিয়ে তুলেছে—যেন তারা মুক্তির পথিকৃৎ। অথচ এই বয়ানের আড়ালে মুছে ফেলা হয়েছে আদিবাসী জাতির রক্তক্ষয়, তাদের সভ্যতার জ্যোতি, তাদের গান ও ভাষার অস্তিত্ব। “ডকট্রিন অফ ডিসকভারি” নাম দিয়ে আদিবাসীদের উচ্ছেদ বৈধ করা হয়, পরে “ম্যানিফেস্ট ডেসটিনি”র ছত্রছায়ায় পশ্চিমমুখী বিস্তারকে ঈশ্বরপ্রদত্ত বলে ঘোষণা করা হয়। স্বাধীনতার যুদ্ধকে এক মহৎ মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে উপস্থাপন করা হলেও, সেই একই সময়ে দাসত্ব, আদিবাসীদের বঞ্চনা ও নারীদের অদৃশ্য উপস্থিতি—সবকিছু অস্বীকার করা হয়। মার্কিন ইতিহাসবিদ হাওয়ার্ড জিন (১৯২২ – ২০১০ খ্রি. ) এই অন্ধকারকে আলোকিত করেছিলেন, যদিও তাঁর কণ্ঠও বিতর্কের বাইরে নয়।

ইতিহাসের উদ্দেশ্য শুধু জানা নয়, বোঝা—মানুষ কেমনভাবে বদলেছে, সমাজ কোন ধারা পেরিয়ে এসেছে, সেইসব থেকে বর্তমানের জন্য শিক্ষা নেওয়া। ইতিহাস আসলে একটি চলমান আলাপ, যা জটিল ও বহুমাত্রিক, যেখানে সত্য একা দাঁড়িয়ে থাকে না, বরং নানা দৃষ্টিভঙ্গির টানাপোড়েনে প্রকাশিত হয়।

এই দৃষ্টিতে ইসলাম (৬২৩ খ্রিস্টাব্দ), খ্রিস্টধর্ম (৩০০ খ্রিস্টাব্দ), ইহুদি ঐতিহ্য কিংবা আমেরিকার ইতিহাস (১৬০০ খ্রিস্টাব্দ)—সবকটি ভিন্ন হলেও একে অপরের সঙ্গে আলাপচারিতায় মিলিত। ইসলামি ইতিহাসে তাবারির মতো ইতিহাসকার ধর্মীয় ও নৈতিক মাত্রাকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন, আবার আধুনিক গবেষকরা আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির প্রসারকে নতুনভাবে বিচার করেন। খ্রিস্টীয় ইতিহাসে নিকেয়া কাউন্সিল (৩২৫ খ্রি.) ও কনস্টান্টাইনের ধর্মরাজনীতি রাজশক্তিকে এক অন্য রূপ দেয়। ইহুদি অভিজ্ঞতায় দ্বিতীয় মন্দির ধ্বংস কিংবা হলোকাস্ট (১৯৩৩-১৯৪৫) শুধু ট্র্যাজেডি নয়, প্রতিরোধ আর টিকে থাকার গল্পও।

ইতিহাসের প্রতিটি ঘটনা নিয়ে নানা কণ্ঠ ভিন্ন ছবি এঁকে দেয়। আমেরিকান বিপ্লবকে কেউ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র মনে করেন, আবার কেউ দেখান—সেই একই সময়ে কৃষ্ণাঙ্গ দাস ও আদিবাসীরা চরম বঞ্চনার শিকার হচ্ছিল। ইসলামি বিস্তারকে সামরিক শক্তির জয় হিসেবে দেখা গেলেও, আসলে বাণিজ্য, সামাজিক সংস্কার আর আধ্যাত্মিক আকর্ষণ ছিল এর অন্তর্নিহিত চালিকা শক্তি। ক্রুসেডকে ইউরোপীয় ইতিহাস যেভাবে মহৎ ধর্মযুদ্ধ বলে দেখায়, ইসলামি ইতিহাস তা চিহ্নিত করে নির্মম আক্রমণ হিসেবে।

তবে ইতিহাস কখনো শুধু ঘটনার শুষ্ক বিবরণ নয়—এটি শিক্ষা, এটি সতর্কবার্তা, এটি স্মৃতি। হলোকাস্টে মানবতার অন্ধকার উন্মোচিত হলেও, একইসঙ্গে এটি প্রতিরোধ ও বেঁচে থাকার প্রতীক। আমেরিকার সিভিল রাইটস আন্দোলন প্রমাণ করেছে যে পরিবর্তন সম্ভব, কিন্তু অসমতার স্থায়ী ছায়া আবার মনে করিয়ে দেয় ইতিহাসের শিক্ষা বারবার হারিয়ে যায়। ভারতের ক্ষেত্রেও আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের হিন্দু নিপীড়নের কাহিনি, কিংবা ভারতকে হিন্দু স্বদেশ হিসেবে স্বীকৃতির দাবি—এসব ইতিহাসের নিরবচ্ছিন্ন আলোচনায় স্থান পায়।

কিন্তু প্রায়শই দেখা যায়, ইতিহাসকে সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা হয়েছে। যারা বিজয়ী, তারাই ইতিহাস রচনা করেছে। আমেরিকান ম্যানিফেস্ট ডেসটিনি, মধ্যযুগের ক্রুসেড, ইসলামি বিজয়যুদ্ধ—সবখানেই প্রতিপক্ষকে অজ্ঞ, বর্বর বা নিকৃষ্ট বলে চিত্রিত করে তাদের ধ্বংসকে বৈধ করা হয়েছে। উপনিবেশবাদী ইউরোপ আফ্রিকা, এশিয়া কিংবা আমেরিকার সভ্যতাগুলোকে “অসভ্য” বলে ঘোষণা করে শোষণ চালিয়েছে। ব্রিটিশরা ভারতে এসে সংস্কৃত সাহিত্য, বেদ-উপনিষদের গরিমা ছোট করে দেখিয়েছে, আবার নিজেদের ক্ষমতার বলয়ে সেগুলো ব্যবহার করেছে।

তবুও, প্রতিরোধের কণ্ঠ কখনো থেমে থাকেনি। নেটিভ আমেরিকান লেখক ভাইন ডেলোরিয়া জুনিয়র (Vine Victor Deloria Jr), কিংবা ফ্যানন, এডওয়ার্ড সাঈদের মতো চিন্তাবিদরা প্রমাণ করেছেন, অন্য দিক থেকেও ইতিহাস লেখা যায়—যেখানে নিপীড়িতরাও কথা বলে।

ইউরোপকেন্দ্রিক ইতিহাস ভারত ও চীনের সভ্যতা বোঝার ক্ষেত্রে সর্বাধিক অক্ষম। ইউরোপ ইতিহাসকে রেখা ধরে দেখে—প্রগতি একদিকে চলবে, আর তার শীর্ষে দাঁড়িয়ে থাকবে শিল্পায়িত পশ্চিম। অথচ ভারতীয় ইতিহাস চক্রাকার, ধারাবাহিক। বৈদিক, মহাকাব্য থেকে গুপ্তযুগ, মুঘল থেকে ঔপনিবেশিক সময়—সব পরিবর্তনের ভেতর দিয়েও ভারতীয় সভ্যতার মূল সত্তা অবিচ্ছিন্ন থেকেছে। চীনের রাজবংশীয় উত্থান-পতনও দেখায়—সভ্যতা ভেঙে পড়ে না, বরং নৈতিকতা আর দর্শনের ভিতরে আবার দাঁড়ায়।

ভারতের ইতিহাসে রামায়ণ-মহাভারতের মতো মহাকাব্য কেবল ঘটনা নয়, মানবজীবনের দার্শনিক বয়ান। রাম বা কৃষ্ণের চরিত্র কালোত্তীর্ণ, কারণ তাঁদের সংগ্রাম মানুষকে শেখায় ধর্ম-অধর্মের দ্বন্দ্ব আসলে মানুষের ভেতরেই থাকে। মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ (৩১০২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) রাজাদের লড়াই নয়, বরং মানবিক দ্বিধার প্রতীক। পুরাণ বা উপনিষদ ইতিহাসকে শুধুই কাহিনি বানিয়ে রাখেনি, বরং দর্শন, প্রকৃতি, সমাজ ও নৈতিক প্রশ্ন একত্রে বুনে দিয়েছে।

একইভাবে, আন্দামানের সেন্টিনেলিরা প্রমাণ করেছে ইতিহাস মানে আধুনিকতার দিকে দৌড় নয়। ষাট হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে তারা বাইরের হস্তক্ষেপ প্রতিহত করে নিজেদের দ্বীপে টিকে আছে, প্রকৃতির সঙ্গে অটুট বন্ধনে আবদ্ধ থেকে। ইউরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গি তাদের “অসভ্য” বা “প্রাচীন” বলে অবজ্ঞা করেছে, কিন্তু বাস্তবে তারা টেকসই জীবনযাত্রার প্রতীক।

সেন্টিনেলিদের জীবন আর বৈদিক সভ্যতার মধ্যে মিল গভীর। উভয়েই প্রকৃতিকে দেবতুল্য জেনেছে, উভয়ের সমাজ স্বনির্ভর ও স্বয়ংসম্পূর্ণ। বৈদিক যজ্ঞ প্রকৃতির উপাদানকে পূজা করেছে, আর সেন্টিনেলিরা তাদের দ্বীপের প্রতিটি গাছ, নদী ও প্রাণীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। বৈদিক সমাজে গ্রাম ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ কেন্দ্র, সেন্টিনেলিরাও বাইরের কারও উপর নির্ভর না করে নিজের জগৎ তৈরি করেছে।

শেষপর্যন্ত দেখা যায়—ইতিহাস কোনো একমুখী কাহিনি নয়। এটি নানা কণ্ঠের বহুস্বর, যেখানে বিজয়ীর সঙ্গে পরাজিতও কথা বলে, যেখানে নীরব মানুষেরাও আস্তে আস্তে শোনা যায়। ইউরোকেন্দ্রিক ইতিহাস যত সীমাবদ্ধ, ততটাই জরুরি বিকল্প ইতিহাস—যেখানে বৈদিক সভ্যতার দর্শন বা সেন্টিনেলিদের মতো জাতির স্থায়িত্ব আমাদের শেখায়, সভ্যতা মানে কেবল ভৌত উন্নয়ন নয়, বরং প্রকৃতির সঙ্গে সমন্বয়, ধারাবাহিক সাংস্কৃতিক চেতনা, আর মানবতার চিরন্তন সত্য।

ঘটনা স্থাপন করার পর আমরা বলতে পারি যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস আসলে এক জনগোষ্ঠীর ইতিহাস, যারা আদি পিতৃভূমি ছেড়ে অজানার পথে যাত্রা শুরু করেছিল ঐতরেয় আরণ্যকের সময় থেকে।  বলা হয়েছে যে বঙ্গ, অবগধ (অর্থাৎ অঙ্গ ও মগধ), এবং চেরপাদ জাতি বেদসংগত ধর্ম ও আচরণ লঙ্ঘন করেছিল এবং পূর্ব দিকে গমন করেছিল।  তাদের জীবন ছিল অনিশ্চয়তায় ভরা, তবুও সাহিত্যের ধারা তাদের সঙ্গেই বয়ে চলেছিল—যেন এক নদী, উৎস থেকে জল সংগ্রহ করে নিরন্তর বয়ে নিয়ে যায় তার স্রোতে। ঐ বৈদিক জনগণ সম্ভবত গঙ্গার পবিত্র ধারার পথ অনুসরণ করেছিল। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তারা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে, বিনিময় করেছে সভ্যতার অংশ—তাদের সংস্কৃতির আলো দিয়েছে, আবার স্থানীয় রীতিনীতির কিছু অংশ নিজের ভেতর গ্রহণ করেছে। ধীরে ধীরে এই মেলবন্ধনে জন্ম নিল এক নতুন ভাষা, যার রূপ পূর্বপুরুষদের সিন্ধু-পাঞ্জাব অঞ্চলের ভাষা থেকে অনেকটাই আলাদা হলেও, তার অন্তর্নিহিত সুর ও প্রাণরস অক্ষুণ্ণ থেকেছে—যা ইস্রায়েলীয় অভিজ্ঞতার সঙ্গেও তুলনীয়।

বাংলা ভাষা সাহিত্যরূপ লাভ করে কন্যাকুব্জ, মগধ, গৌড় ও শ্রীহট্টের মতো পূর্ব ভারতের ভূখণ্ডে। পরে বঙ্গভূমির আদিবাসিরা ইসলামি শাসক ও ব্রিটিশ বণিকদের অধীনে পড়ে, কিন্তু ইতিহাসের ধারায় উভয়কেই তারা বিদায় দেয়। শেষপর্যন্ত জন্ম নেয় তিনটি বাঙালি ভূখণ্ড—পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ ও ত্রিপুরা।

ইতিহাস শেষ পর্যন্ত এক আয়না—যেখানে অতীতের আলো-অন্ধকার প্রতিফলিত হয়, আর সেখান থেকে ভবিষ্যতের পথচলার দিশা খুঁজে নেওয়া যায়। অতএব, যদি আমরা বাংলা ভাষা, ব্যাকরণ ও সাহিত্যর ইতিহাস লিখতে চাই, তবে তা কোনো ইউরোপীয় কল্পনাপ্রসূত ইতিহাসচর্চার ধাঁচে লেখা সম্ভব নয়। এই ইতিহাসকে দাঁড়াতে হবে বঙ্গজাতির স্বানুভূতির উপর, সেই অভিজ্ঞতার ভিতরে যা বৈদিক ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত এবং বৃহত্তর ভারতের সাংস্কৃতিক কাঠামোর অন্তর্গত।

বুধবার, ২৭ আগস্ট, ২০২৫


Leave a Reply