Date: 11th March 2025
নাগার্জুনগীতিকা
বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন ইতিহাসে ১০৫০ খ্রিস্টাব্দের নাগাদ রচিত ‘নাগার্জুনগীতিকা’ এক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। এই গ্রন্থের রচয়িতা নাগার্জুন (১০৫০ খ্রিস্টাব্দ), যিনি বাংলার অন্যতম প্রাচীন গীতিকাব্যের স্রষ্টা। তবে এই নাগার্জুন মহাযান বৌদ্ধদর্শনের প্রধান আচার্য, “মধ্যমক কারিকা” রচয়িতা নাগার্জুনের (২য় শতক) সঙ্গে বিভ্রান্ত হওয়ার নয়।
‘নাগার্জুনগীতিকা’ বাংলার প্রাচীন সহজিয়া বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সঙ্গে জড়িত এবং এটি এক বিশেষ সংগীতধর্মী সাহিত্য, যেখানে সহজ সাধনার দার্শনিক দিকগুলি কাব্যরূপে পরিবেশিত হয়েছে।
নাগার্জুন (১০৫০ খ্রিস্টাব্দ) ও তাঁর সাহিত্য
(ক) নাগার্জুনের পরিচয়
বাংলার ইতিহাসে ১০৫০ খ্রিস্টাব্দের নাগার্জুন ছিলেন একজন বৌদ্ধ সহজিয়া সাধক। যদিও তাঁর জীবন সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য নেই, তবে তাঁর রচিত ‘নাগার্জুনগীতিকা’ থেকে বোঝা যায় যে, তিনি বৌদ্ধ সহজযান ও তন্ত্রধর্মের অনুসারী ছিলেন।
এই সময় বাংলা অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব কমে আসছিল, এবং বৌদ্ধ সম্প্রদায় বিভিন্ন মতবাদের বিভাজনে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। নাগার্জুনের কাব্যে এই ভাঙনের চিত্র ফুটে উঠেছে।
(খ) ‘নাগার্জুনগীতিকা’ গ্রন্থের বৈশিষ্ট্য
‘নাগার্জুনগীতিকা’ একটি সংকীর্তনধর্মী গীতিকাব্য, যা সহজিয়া দর্শনের উপর ভিত্তি করে রচিত। এতে সহজ সাধনার মূলনীতি ও গূঢ় অর্থ গানের মাধ্যমে ব্যক্ত করা হয়েছে।
- সংকীর্তনমূলক রচনা: এতে সহজ সাধনার আদর্শ গান আকারে প্রকাশিত হয়েছে।
- বৈষ্ণব কীর্তনের পূর্বসূরি: পরবর্তীকালে বৈষ্ণব পদাবলীতে যে সংকীর্তনরীতি দেখা যায়, তার মূল কিছু উপাদান এখানে পাওয়া যায়।
- বৌদ্ধ সহজিয়াদের আধ্যাত্মিক চেতনা: সহজ দর্শন ও সহজভাবে মোক্ষলাভের কথা এতে আলোচিত হয়েছে।
‘নাগার্জুনগীতিকা’ ও বৌদ্ধ সংগীতধারা
(ক) বাংলার প্রাচীন সংকীর্তনধর্মী গান
চৈতন্যদেবের জন্মের ৬০০ বছর আগেই বাংলা ও পূর্ব ভারতের বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ (সিদ্ধাচার্য বলতে বৌদ্ধদের একটি দলকে বোঝায় যারা নিজেদেরকে সিদ্ধ বলে ডাকত, তাদের বেশিরভাগই ছিল নিম্নশিক্ষিত এবং ভবঘুরে। ) সংগীতের মাধ্যমে ধর্ম প্রচার করতেন। তাঁদের গান ও রাগ-রাগিণীর প্রভাব বাংলা কীর্তনধারার উপর ন্যূনতম প্রভাব বিস্তার করেছে।
(খ) ‘নাগার্জুনগীতিকা’ ও প্রাচীন রাগ-রাগিণী
নাগার্জুনের গীতিকায় বিভিন্ন রাগ ব্যবহৃত হয়েছে, যেমন—
- পটমঞ্জরী, গবড়া, অরু, গুঞ্জরী, দেবক্রী, দেশাখ, ভৈরবী
- কামোদ, ধানশী, রামক্রী, বরাড়ি, শীবরী, বলাড্ডি, মল্লারি, বাঙ্গালা ইত্যাদি
এইসব রাগগুলির প্রভাব পরবর্তী বাংলা সংগীতে লক্ষ করা যায়, বিশেষ করে বৈষ্ণব সংকীর্তনে।
‘নাগার্জুনগীতিকা’ ও বৌদ্ধ দোঁহা সাহিত্য
(ক) দোঁহার সাথে সম্পর্ক
বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ গীতি ছাড়াও দোঁহা রচনা করতেন, যা পরে বাংলা কবিতার পয়ার ছন্দের ভিত্তি তৈরি করে। সরহপাদ ও অন্যান্য সহজিয়া কবিদের দোঁহার প্রভাব ‘নাগার্জুনগীতিকা’-তেও দেখা যায়।
(খ) অন্যান্য দোঁহা সংগ্রহ
- সরহপাদ রচিত ‘দোঁহাকোষ’
- কৃষ্ণাচার্য্যের ‘দোঁহাকোষ’
- তেলিপের দোঁহা
- বিরূপের দোঁহা
এছাড়া, সহজিয়া দর্শনের তত্ত্বকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দোঁহাগুলি ব্রাহ্মণ্যবাদ ও মহাযান মতবাদকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
‘নাগার্জুনগীতিকা’ ও গাথা সাহিত্য
(ক) গাথাভাষার উদ্ভব
বৌদ্ধ সাহিত্যে গাথা এক বিশেষ রীতির সাহিত্য, যা প্রাচীন প্রাকৃত ও বাংলার সংমিশ্রণে গঠিত হয়েছিল। ‘নাগার্জুনগীতিকা’ গাথা সাহিত্যের একটি রূপান্তরিত রূপ বলে ধারণা করা হয়।
(খ) প্রাচীন গাথাগুলির সংরক্ষণ
- ‘সার্দ্ধপঞ্চ-গাথা’ (নাগার্জুনগর্ভ কর্তৃক সংকলিত)
- শ্রীগিরি, সবর, কর্মপাদ ও নাড়পাদের গাথা
গাথার ভাষা ক্রমে সংস্কৃত ও বাংলার সংমিশ্রণে গঠিত হয়ে বাংলা গীতিকাব্যের ভিত্তি তৈরি করে।
‘নাগার্জুনগীতিকা’ ও বাংলা সাহিত্যের ধারা
(ক) বৈষ্ণব সাহিত্য ও নাগার্জুনের প্রভাব
‘নাগার্জুনগীতিকা’ বাংলার পরবর্তী বৈষ্ণব পদাবলীর উপর প্রভাব বিস্তার করে। সহজিয়া সাধকদের গান ও রাগ বৈষ্ণব কীর্তনের মূল সুরটি গড়ে তোলে।
(খ) বাংলা কাব্য ও নাগার্জুন
- সহজিয়া বৌদ্ধদের গীতিধারা থেকেই বাংলা পদাবলী কাব্যের জন্ম।
- গান ও সংকীর্তনধর্মী কাব্য বাংলা সাহিত্যের প্রথম দিকের ধারাগুলোর অন্যতম।
‘নাগার্জুনগীতিকা’ বাংলা সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ, যা সংকীর্তন ও সহজিয়া দর্শনের উপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে।
- নাগার্জুন (১০৫০ খ্রিস্টাব্দ) বাংলার প্রাচীনতম সংগীতধর্মী কবিদের অন্যতম।
- তাঁর ‘নাগার্জুনগীতিকা’ পরবর্তী বৈষ্ণব কীর্তনের রূপগঠনে বিশাল ভূমিকা রাখে।
- বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের সংগীত ও দোঁহার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের প্রাথমিক কাঠামো নির্মিত হয়।
অতএব, ‘নাগার্জুনগীতিকা’ কেবল একটি প্রাচীন সাহিত্যকর্ম নয়, এটি বাংলা সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ, যা পরবর্তী কালের বাংলা কবিতা ও সংগীতের পথ তৈরি করে দিয়েছে।