আমেরিকায় ইহুদি অভিবাসনের ইতিহাস: সংগ্রাম থেকে সাফল্যের পথে
প্রথম ইহুদি (Jews) অভিবাসীরা প্রায় ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে নিউ অ্যামস্টারডামে এসে পৌঁছেছিল। তারা ছিল তেইশজন মানুষ, যারা ব্রাজিলের রেসিফে শহর থেকে সাঁতে ক্যাথেরিন জাহাজে চেপে এসেছিল। পর্তুগিজ খ্রিস্টান ইনকুইজিশনের (ক্যাথলিক ১৫৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়) ভয়াবহতা থেকে বাঁচতেই তারা নতুন দুনিয়ার পথে রওনা হয়েছিল। ১৫৪২ সালে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে পর্তুগালের রাজা তৃতীয় জন কুখ্যাত ফ্রান্সিস জেভিয়ার আর মার্টিন আলফোনসোকে ভারতের গোয়ায় পাঠান। তাদের উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু আর ইহুদিদের রোমান ক্যাথলিক ধর্মে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করা। ইনকুইজিশনের ভয়াবহতায় তখন গোয়ায় দশ হাজারেরও বেশি হিন্দু ও ইহুদিকে হত্যা করা হয়েছিল।
এই প্রথম দিককার ইহুদিরা ছিল মূলত সেফারদিম (মেষপালক), যারা স্পেন আর পর্তুগাল থেকে তাড়িত হয়েছিল খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হতে অস্বীকার করার কারণে। নতুন দেশে তারা বেঁচে থাকার উপায় খুঁজে নিল বাণিজ্যেই—দোকানদার, ব্যবসায়ী আর জাহাজপথে মালবাহী হিসাবে। কেউ কেউ প্রচুর সম্পদও অর্জন করেছিল—যেমন ফ্রাঙ্কস, গোমেজ, গ্রাটজ, হার্ট, হেয়স, লেভি আর সিমসন পরিবার, আর ব্যক্তি হিসেবে অ্যারন লোপেজ আর তাঁর শ্বশুর জ্যাকব রিভেরা। তবে বেশির ভাগই ছিল সাধারণ মানুষ, অস্থির ঔপনিবেশিক অর্থনীতির ভেতর দারিদ্র্য আর সংগ্রামের মধ্যে বেঁচে ছিল। তাদের বড় লড়াই ছিল কেবল টিকে থাকা নয়, নতুন দুনিয়ায় ধর্মটাকেও টিকিয়ে রাখা।
১৭৭৬ সালের দিকে ব্রিটিশ উত্তর আমেরিকার উপনিবেশগুলোতে প্রায় দুই হাজার ইহুদি বসবাস করছিল। বেশির ভাগই এসেছিল ডাচ প্রজাতন্ত্র, ব্রিটেন আর আইবেরিয়ান উপদ্বীপ থেকে। তারা গড়ে তোলে কনগ্রেগেশন শেআরিথ ইস্রায়েল—যা ১৮২৫ সাল পর্যন্ত আমেরিকার একমাত্র ইহুদি উপাসনালয় ছিল। ১৬৮২ সালের কাছাকাছি তারা নিউ ইয়র্কে চ্যাথাম স্কোয়ার সেমেট্রির জমি কেনে, যা আজও দাঁড়িয়ে আছে—সবচেয়ে পুরনো ইহুদি কবরস্থান হিসেবে। এর শিলালিপিতে স্প্যানিশ, পর্তুগিজ আর হিব্রু ভাষার ছাপ মেলে। ১৭৩০ সালে তারা ম্যানহাটনের মিল স্ট্রিটে প্রথম সিনাগগ নির্মাণ করে।
নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় ইহুদিরা আমেরিকার অর্থনীতি ও সমাজ জীবনে জায়গা করে নিতে থাকে। ১৭৮৫ সালে নিউ ইয়র্ক যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম রাজধানী হয় সংবিধান গৃহীত হওয়ার পর। ১৭৯২ সালে চৌব্বিশ জন স্টকব্রোকারের মধ্যে পাঁচজন ছিলেন ইহুদি, যারা ওয়াল স্ট্রিটের এক বড় সিকামোর গাছের নিচে বাটনউড এগ্রিমেন্টে সই করেন। এই চুক্তিই পরবর্তীতে নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের ভিত্তি স্থাপন করে। ১৮৪০ সালের মধ্যে আমেরিকায় ইহুদিদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় পনেরো হাজার। ১৮৫১ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমস প্রথম সংখ্যা প্রকাশ করে।
গৃহযুদ্ধের সময় ইহুদিরা বৈষম্যের মুখেও পড়ে। ১৮৬২ সালের ডিসেম্বরে জেনারেল ইউলিসিস এস. গ্রান্ট পশ্চিম টেনেসি, মিসিসিপি আর কেন্টাকি অঞ্চলে জারি করেন আদেশ—জেনারেল অর্ডার নং ১১—যাতে ইহুদিদের ওই অঞ্চল থেকে বহিষ্কারের কথা বলা হয়। পরে এই আদেশ বাতিল হয়, তবে অপমানের দাগ থেকে যায়। একই সময়ে আর্নেস্ট নাথান ব্রুকলিনে প্রথম কোশের কসাইখানা খুলে দেন, যা পরবর্তীতে গোটা মাংস প্রক্রিয়াজাত শিল্পের ভিত্তি গড়ে তোলে।
ঊনবিংশ শতকের শেষ আর বিংশ শতকের শুরুর দিকেই আসে ইহুদি অভিবাসনের সবচেয়ে বড়নাৎসি জার্মানি ঢেউ। ১৮৮০ থেকে ১৯২৪ সালের মধ্যে প্রায় বিশ লক্ষ ইহুদি আমেরিকায় আসে, এদের অধিকাংশই পূর্ব ইউরোপ থেকে। ১৯১৮ থেকে ১৯২০ সালের মধ্যেই সর্বাধিক মানুষ ঢোকে, যখন ইউক্রেনে ভয়াবহ দাঙ্গায় প্রায় এক লক্ষ ইহুদি নিহত হয়েছিল। ১৯২৪ সালের মধ্যেই প্রায় দুই মিলিয়ন ইহুদি আমেরিকায় বসতি গড়ে, তবে সেই বছরই জাতীয় উত্স কোটার আইন পাস হয়, যা পূর্ব আর দক্ষিণ ইউরোপ থেকে অভিবাসন প্রায় বন্ধ করে দেয়। ইহুদিরা প্রবলভাবে এই সীমাবদ্ধতার বিরোধিতা করে। এর মধ্যেই ১৯১৪ সালের দিকে প্রায় বিশ লক্ষ ইয়িদ্দিশভাষী আশকেনাজি ইহুদি আমেরিকায় এসে গিয়েছিল।
এ সময় ইহুদিরা আমেরিকার আর্থিক ক্ষেত্রেও দাগ কাটে। গোল্ডম্যান স্যাক্স, কুন লোব, লেহম্যান ব্রাদার্স, স্যালোমন ব্রাদার্স, বাচ অ্যান্ড কো. আর সেলিগম্যানের মতো বিনিয়োগ ব্যাংকগুলোর প্রতিষ্ঠাতা ছিল ইহুদিরা। তবে ত্রিশের দশক নাগাদ এই প্রভাব অনেকটা কমে আসে। একই সময়ে তারা নাৎসি জার্মানি থেকে পালানো ইহুদিদের প্রবেশাধিকারের জন্য প্রাণপণ সংগ্রাম করছিল। ১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লবের পর প্রায় ষাট থেকে আশি হাজার পারস্য ইহুদিও আমেরিকায় আশ্রয় নেয়। ১৯৭৩ সালে ব্রুকলিনের ব্রাউনসভিল থেকে উঠে আসা আবি বিম নিউ ইয়র্ক সিটির প্রথম ইহুদি মেয়র নির্বাচিত হন।
২০১০ সালে আমেরিকায় ইহুদির সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৫৪ লক্ষ, আর ২০২০ সালে তা বেড়ে ৭৫ লক্ষে পৌঁছে যায়—যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ২.৪ শতাংশ। ধর্মীয়ভাবে তারা ভাগ হয়ে আছে রিফর্ম, কনসারভেটিভ আর অরথোডক্স ধারায়। আজকের আমেরিকার ইহুদিরা মূলত আশকেনাজি, যারা পূর্ব ইউরোপ আর জার্মানির বংশধর, আর যাদের পূর্বপুরুষেরা ইয়িদ্দিশ ভাষায় কথা বলত। বর্তমানে ষোলোটি অঙ্গরাজ্যে হলোকাস্ট শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
প্রথম দিকের সেফারদিক শরণার্থী থেকে শুরু করে পূর্ব ইউরোপের লাখো আশকেনাজি পর্যন্ত, আমেরিকায় ইহুদিদের ইতিহাস আসলে সংগ্রাম আর সাফল্যের ইতিহাস। কয়েক ডজন শরণার্থী থেকে আজ তারা আমেরিকার সংস্কৃতি, ধর্ম আর জনজীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।
শুক্রবার, সেপ্টেম্বর 19, 2025
১৪৩২ বঙ্গাব্দ