নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়
জওহরলাল
১৯৪৮
এক
নাহার ক্রমশ হইল নেহরু
তখন মুঘল সাম্রাজ্য ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে। দিল্লীর সিংহাসনে বাদশাহ ফারুকশীয়ার।
ফারুকশীয়ার (১৭১৩ থেকে ১৭১৯) কাশ্মীর বেড়াইতে গিয়া এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পণ্ডিতের সঙ্গে পরিচিত হইলেন। তাঁহার নাম রাজকেলি। তাঁহার পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হইয়া বাদশাহ তাঁহাকে রাজধানী দিল্লীতে আমন্ত্রণ করিয়া আনিলেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস করিবার জন্য এক পরিখার ধারে বিস্তীর্ণ জায়গীর দান করিলেন।
সেই পরিখার ধারে নূতন করিয়া অট্টালিকা নির্ম্মাণ করিয়া রাজকেলি বসবাস করিতে লাগিলেন। উর্দু ভাষায় পরিখাকে বলে “নাহার”। নাহারের ধারে বাড়ী বলিয়া তাঁহাদের পদবীর সঙ্গে নাহার কথাটা জুড়িয়া গেল। কালক্রমে আসল পদবীটি লুপ্ত হইয়া গিয়া “নাহার” কথাটাই রহিয়া গেল। নাহার ক্রমশ হইল নেহরু।
ভারতবিখ্যাত নেহরু পরিবারের ইহাই হইল সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
তখন ভারতের চারিদিকে ভাঙ্গন শুরু হইয়া গিয়াছে। অত বড় যে মুঘল সাম্রাজ্য তাহা ভাঙ্গিয়া টুক্রা টুক্রা হইয়া যাইতেছে। মারাঠারা বর্গী সাজিয়া দেশময় লুঠতরাজ করিয়া বেড়াইতেছে। গৃহস্থদের মনে সুখ নাই।
ওধারে সেই সুযোগে ইংরেজরা একটার পর একটা রাজ্য দখল করিয়া বেড়াইতেছে। সারা ভারতবর্ষ তখন যেন একটা ফুটন্ত জলের কড়ার মত টগবগ করিতেছে। সবই অস্থির-চঞ্চল–
এমন সময় দেখা দিল সিপাহীবিদ্রোহ—সিপাহীবিদ্রোহের কয়েক বৎসর আগে গঙ্গাধর নেহরু দিল্লীর শহর-কতোয়াল ছিলেন।
সিপাহীবিদ্রোহের ফলে নেহরু-পরিবারের সমস্ত নষ্ট হইয়া গেল। বিদ্রোহীরা বাড়ীতে বাড়ীতে আগুন ধরাইয়া দিয়। কাগজপত্র দলিল-দস্থাবেজ সব পুড়াইয়া দিল।
প্রাণভয়ে গঙ্গাধরের দুই তরুণ-বয়স্ক পুত্র এবং এক কন্যা ভীতআর্ত্ত জনতার সঙ্গে পায়ে হাঁটিয়া দিল্লী ত্যাগ করিয়া চলিলেন। পথে যে কোন মূহূর্ত্তে মৃত্যুর সহিত দেখা হইতে পারে।
সৌভাগ্যবশত গঙ্গাধরের এক পুত্র সামান্য কিছু ইংরেজী জানিতেন। সেকালে ইংরেজী-জানা লোক সারা ভারতবর্ষে খুব বেশী ছিল না।
পথে একদল ইংরেজ সৈনিক তাঁহাদের সঙ্গীণের মুখে আটকাইল। গঙ্গাধরের কন্যাটীর রঙ ছিল, মেমেদের চেয়েও শুভ্র। কাশ্মীর-কন্যাদের দেহের রঙের শুভ্রতা আজও গর্ব্বের বিষয়।
ইংরেজ সৈনিকদের ধারণা হইল যে, কোন ইংরেজ-শিশুকন্যকে ইহারা ছদ্মবেশ পরাইয়া চুরি করিয়া লইয়া যাইতেছে।
সে-সময় বিচার এবং শাস্তি নিমেষের মধ্যে হইয়া যাইত; এবং এই ধরণের অপরাধের একমাত্র শাস্তি হইল, মৃত্যু।
তাঁহাদের হত্যা করিবার জন্য সৈনিকেরা যখন সঙ্গীন তুলিয়াছেন, সেই সময় গঙ্গাধরের যে পুত্রটী কিছু ইংরেজী জানিতেন, সেই অল্প পুঁজির সাহায্যেই তিনি বহু কষ্টে ইংরেজ সৈনিকদিগকে বুঝাইলেন যে, তাঁহারা বিপ্লবী নন্, বিপ্লবীদের অত্যাচারে তাঁহারাও তাঁহাদের যথাসর্ব্বস্ব ফেলিয়া পরীবারবর্গকে লইয়া পলাইতেছেন।
এইভাবে সেই সামান্য ইংরেজী ভাষাজ্ঞানের সৌভাগ্যে তাঁহারা সে-যাত্রা প্রাণে বাঁচিয়া গেলেন। দিল্লী ত্যাগ করিয়া তাঁহারা আগ্রায় আসিয়া নূতন করিয়া বসবাস আরম্ভ করিলেন।
এই আগ্রায় বাস করিবার সময় গঙ্গাধর দেহত্যাগ করেন এবং তাঁহার মৃত্যুর তিনমাস পরে তাঁহার তৃতীয় সন্তান পণ্ডিত মতিলাল নেহেরু জন্ম গ্রহণ করেন, ১৮৬১ খ্রীষ্টাব্দের ৬ই মে।
স্বভাবতই শিশু মতিলালের, লালন-পালনের ভার পড়িল, তাঁহার পিতৃতুল্য দুই অগ্রজ, বংশীধর নেহরু ও নন্দলাল নেহরুর উপর।
কালক্রমে নন্দলাল আইন অধ্যয়ন করিয়া ওকালতী ব্যবসা আরম্ভ করেন।
এলাহাবাদে হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠা (১৮৬৬ সালের ১৭ মার্চ) হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আগ্রা ত্যাগ করিয়া তিনি এলাহাবাদে বসবাস স্থাপন করিলেন এবং অচিরকালের মধ্যে সেখানকার সব চেয়ে বড় উকীল বলিয়া পরিগণিত হইলেন।
এলাহাবাদ হাইকোর্টে নন্দলাল যে প্রতিষ্ঠা অর্জন করিয়াছিলেন, তাঁহার কনিষ্ঠ ভাই মতিলাল সে প্রতিষ্ঠাকে ভারতব্যাপী করিয়া তুলিলেন। লক্ষ্মী ও সরস্বতী তাঁহার ঘরে বাঁধা পড়িয়া গেল। তাঁহার প্রতিভার খ্যাতির সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার ঐশ্বর্য্য ও বিলাসিতার কাহিনী লোকমুখে কিংবদন্তীতে পরিণত হইয়া গেল।
মতিলাল নেহরু পরিবারকে পূরাদস্তুর য়ুরোপীয় শ্রেষ্ঠ সম্ভ্রান্ত পরিবারদের আদর্শে এবং রাজনীতিতে গড়িয়া তুলিলেন। য়ুরোপে, য়ুরোপীয় বিধি-ব্যবস্থা এবং জীবনযাত্রা- প্রণালীকে তিনি ভালবাসিয়া গ্রহণ করিলেন। সে দিকে সহায়তা করিল তাঁহার বিপুল আয়।
উকীল হিসাবে এত আয় তাঁহার পূর্ব্বে ভারতবর্ষে আর কেহ করে নাই। এলাহাবাদে তাঁহার বাড়ী বড় বড় সব সাহেব রাজকর্মচারী ও রাজ-রাজড়াদের প্রধান আড্ডা হইয়া উঠিল।
এই ঐশ্বর্য্য, প্রাচুর্য্য, বিলাসিতা আর য়ুরোপীয় আবহাওয়ার মধ্যে ১৮৮৯ খৃষ্টাব্দের ১৪ই নভেম্বর, ভারতের নব্য-জাতীয়তার পতাকাধারী—বীর সৈনিক জওহরলাল জন্মগ্রহণ করিলেন।
