ভারতীয় মননের ধারা

ভারতীয় মননের ধারা

ভারতীয় মননের গন্তব্য—পরমার্থলাভে অবিচল পথচলা

ভারতীয় মননের ধারা সর্বদাই মুক্তিপরায়ণ, সৎ ও চিরশ্রেয়সের সন্ধান-প্রবণ। ভারতবর্ষের বহু সহস্রাব্দব্যাপী সাধনা যাহা দর্শন নামে সমাহিত, তাহার অন্তর্লীন গূঢ় অভিপ্রায় একটিই—পরমার্থের সাধন। তবে এই সাধনলক্ষ্মী কোনও একরৈখিক বা একমাত্রিক নহে; ইহা বহুধা, বহুসম্মিলিত, বহুসমন্বিত।

পূর্বমীমাংসার প্রারম্ভে যেই গম্ভীর উচ্চারণ—“অথাতো ধর্মজিজ্ঞাসা”, তাহা আসলে ভারতীয় চিন্তাচেতনার এক মৌল অভিসন্ধির সূচক। ধর্ম মানে কেবল আচরণবিধি নহে, বরং উহা অনুপ্রেরণা, প্রাণের আয়াম—অর্থাৎ সেই অর্থই ধর্ম যাহা বেদীয় দ্যোতন দ্বারা নির্ধারিত। ইহা হইতে বুঝা যায়, যে অনুশাসন দ্বারা মানবকে কৃতব্যের পথে প্রবৃত্ত করা হয়, তাহাকেই ধর্ম বলা হয়, এবং তাহার প্রকৃতির সন্ধান করাই মীমাংসার লক্ষ্য।

কিন্তু ইহা কেবল বহিঃকর্মের অনুশাসন নহে—ন্যায়দর্শনের সূত্রে বলা হইয়াছে,
“प्रमाण प्रमेय संशय प्रयोजन दृष्टान्त सिद्धान्त…हेत्वाभास…तत्त्वज्ञानात् निःश्रेयसाधिगमः”

অর্থাৎ প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান ও শব্দ—এই চতুঃপ্রমাণের দ্বারা যথার্থ জ্ঞান লাভ হইলে, তাহা নিঃশ্রেয়স (চরম কল্যাণ) লাভের পথপ্রদর্শক হইয়া থাকে। এখানেই ভারতীয় যুক্তি ও যুক্তিচিন্তার গুরুত্ব, কিন্তু এই যুক্তি এক নির্মম নিসর্গবাদ নহে—ইহা মোক্ষলক্ষ্মী, নিঃশ্রেয়সোপযোগী।

ভৌতিক দুঃখের তিন প্রকৃতি—আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক, এবং অধিদৈবিক—ইহার হইতে চূড়ান্ত মুক্তি ‘অত্যন্তপুরুষার্থ’ বলিয়া সাংখ্যদর্শনে ঘোষিত। সাংখ্যর দৃষ্টিতে সেই পুরুষার্থ হইল—চেতন পুরুষের প্রকৃতিসম্ভূত বন্ধন হইতে নিস্কৃতি। কিন্তু এই মুক্তি কেবল দার্শনিক জ্ঞানেই সীমাবদ্ধ নহে—ইহা এক ব্যাধিস্বরূপ মানসবৃত্তির নিবৃত্তি। এই বৃত্তিনিরোধই যোগদর্শনের সূত্রবাক্যে ঘোষণা—“योगश्चित्तवृत्तिनिरोधः”। তখন দ্রষ্টা আপন স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হন—“तदा द्रष्टुः स्वरूपेऽवस्थानम्”

এই দ্রষ্টার স্বরূপেরই আরেক অন্বেষণ ব্রহ্মসূত্রে ঘোষিত—“अथातो ब्रह्मजिज्ञासा”, এখন ব্রহ্মের জিজ্ঞাসা (করিব)। কেননা, সকল জগতের উৎপত্তি, স্থিতি ও লয় যাহা হইতে হয়—“জন্মাদ্যস্য যतः”—তাহাই ব্রহ্ম। এবং শাস্ত্রই সেই ব্রহ্মজ্ঞানের (জিজ্ঞাসার) উৎস—“শাস্ত্রযোনিত্বাত্”। তবে এই বিচ্ছিন্ন সূত্রাবলির মধ্যে এক সুসংহত ঐক্য আছে, যাহা ব্রহ্মসূত্রের ‘সমন্বয়’ নীতিতে, সংশ্লেষণে (তত্তু সমন্বয়াত্ব্রহ্মসূত্র ১.১.৪) প্রকাশিত।

বেদান্তসূত্রকার বাদরায়ণ এই সূত্রে এইটিই প্রতিপাদন করিয়াছেন যে, সমস্ত শ্রুতি—জন্ম, লয়, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, আত্মা, ঈশ্বর, কর্ম, পুনর্জন্ম, মোক্ষ—এই সমস্ত বিষয়ে যাহা যাহা বলে, তাহার অন্তর্লীন মর্মতত্ত্ব কেবল একটিই, আর তাহা হইলো ব্রহ্ম। অর্থাৎ “ব্রহ্মই সর্ববেদবাক্যের অভিপ্রেত অর্থ”—এই সিদ্ধান্তই ‘তত্তু সমন্বয়াত্’ সূত্রের সারনির্যাস।

এই সমন্বয়বোধই ভারতীয় দর্শনের প্রাণ। কেহ বেদবাক্যকে সর্বোচ্চ প্রমাণ মানিয়া ধর্ম নিরূপণ করেন (মীমাংসা), কেহ সেই ধর্মের ফলস্বরূপ পরমার্থরূপে নিঃশ্রেয়সের সন্ধান করেন (ন্যায়, বৈশেষিক), কেহ জগতের মূল দুঃখসমূহ চিহ্নিত করে তাহা হইতে মুক্তির পন্থা নির্ধারণ করেন (সাংখ্য, যোগ), আবার কেহ সেই পুরুষ ও প্রকৃতির পারমার্থিক ব্যাখ্যা করিতে ব্রহ্মতত্ত্বের অভিমুখে যাত্রা করেন (উত্তরমীমাংসা বা বেদান্ত)।

অধিকন্তু ভারতীয় দর্শনের আলোচনায় বৈশেষিক সূত্র এক বিশেষ উচ্চাসন অধিকার করিয়া আছে। ইহার সূচনাতেই উচ্চারিত হইয়াছে—“অথাতো ধর্ম ব্যাখ্যাস্যামঃ”, অর্থাৎ, এখন আমরা ধর্ম ব্যাখ্যা করিব। পূর্বমীমাংসা যেমন ধর্মজিজ্ঞাসা দ্বারা যাত্রা আরম্ভ করিয়াছে, তদ্রূপে বৈশেষিকও ধর্মকেই চিন্তনের প্রথম ও প্রধান বস্তু জ্ঞান করিয়াছেন। তবে বৈশেষিকের দৃষ্টিভঙ্গি সামান্য ভিন্ন। এখানে ধর্মের সংজ্ঞা—“যতোऽভ্যুদয় নিঃশ্রেয় স সিদ্ধিঃ স ধর্মঃ”। যে ধর্ম মনুষ্যের ইহলোকীয় কল্যাণ (অভ্যুদয়) এবং পরলোকীয় চরম মুক্তি (নিঃশ্রেয়স) প্রদান করে, তাহাই প্রকৃত ধর্ম। ইহা বিশুদ্ধরূপে ফলসিদ্ধ ধর্মতত্ত্ব—মানবজীবনের দ্বিধা উদ্দেশ্যরূপ অভ্যুদ্বয় ও মোক্ষকে একসূত্রে গাঁথিয়া ধর্মের মূর্ত রূপরেখা স্থাপন করিয়াছে।

এই ধর্মের আধার শাস্ত্র, এবং সেই শাস্ত্রের প্রামাণ্যতা কোথা হইতে উদ্ভূত? বৈশেষিক উত্তর দেয়—“তদ্বচনাদাম্নায় প্রামাণ্যম্”। অর্থাৎ, যেহেতু এই অভ্যুদ্বয় ও নিঃশ্রেয়স লাভ হয় শাস্ত্রের নির্দেশেই, সেহেতু শাস্ত্রই প্রামাণ্য। এখানে ‘আম্নায়’ অর্থে বেদ; এবং বেদপ্রণীত বাক্যসমূহই ধর্মজ্ঞান ও কর্মজ্ঞান উভয়ের প্রামাণ্য আধার।

এই ধর্ম ও জগৎ সম্পর্কিত তত্ত্বের ভিত্তিতে বৈশেষিক এক বিশদ বস্তুতত্ত্ব স্থাপন করিয়াছেন। প্রকৃতির মৌলিক উপাদানসমূহ—পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু, আকাশ, কাল, দিক্, আত্মা ও মন—এই ন’টি দ্রব্যরূপে নির্ধারিত। ইহারা সকলেই ধর্মসাধনার পরিপ্রেক্ষিতে জ্ঞেয়। এবং এই দ্রব্যসমূহ যেই গুণ ও কর্ম দ্বারা চিহ্নিত, তাহার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে গীত হয়—“রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ, সংখ্যা, পরিমাণ, পৃথকত্ব, সংযোগ, বিভাগ, পরত্ব, অপরত্ব, বুদ্ধি, সুখ-দুঃখ, ইচ্ছা, দ্বেষ, চেষ্টা”—ইহারা সকলই গুণ। এই গুণগুলি না হইলে দ্রব্য চিন্তনাতীত। এবং ক্রিয়া বা কর্মের সূচকরূপে উচ্চারিত হইয়াছে—“উৎক্ষেপণ, অবক্ষেপণ, আকুঞ্চন, প্রসারণ ও গমন”—এই পাঁচ প্রকার কর্ম।

এইভাবে, বৈশেষিক এক দার্শনিক বস্তুতত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করিয়াছে যাহা ধর্ম, অভ্যুদ্বয় ও মোক্ষ—এই ত্রিধা মানব-উদ্দেশ্যের সহিত অবিচ্ছেদ্য সংযুক্ত। বস্তু, গুণ, কর্ম—ইহাদের যথাযথ অন্বয় ও বিশ্লেষণ ব্যতীত ধর্ম বোধ্য নয়, এবং ধর্ম ব্যতীত মোক্ষও দুরাগম্য।

ভারতীয় দর্শনের একত্রিত চিন্তাধারায় যাহা প্রতীয়মান, তাহা হইল—এক সুশৃঙ্খল দার্শনিক উত্তরাধিকার, যাহা শ্রুতির অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য উপলব্ধি করিবার জন্য বিভিন্ন প্রজ্ঞাপুরুষের দ্বারা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ হইতে অনুসন্ধিত্সা ও বিশ্লেষণ সম্পন্ন হইয়াছে। এই ধারায় ঋষি জৈমিনির पूर्वमीमांसा দর্শন এক মৌলিক সূত্ররূপে আত্মপ্রকাশ করিয়াছে—“अथातो धर्मजिज्ञासा”। জৈমিনি প্রশ্ন করিলেন, ‘ধর্ম কী?’—উত্তরে বলিলেন—“চোদনা লক্ষণোऽর্থো ধর্মঃ”—যাহা বেদীয় আদেশ (আম্নায়) দ্বারা অনুপ্রাণিত, তাহাই ধর্ম। তবে ইহা কেবল বিধি বা নিষেধ নহে, বরং এক কার্যগত অনুশাসন, যাহা মানবচরিত্রে কর্তব্যের প্রেরণা জাগায়।

এই ধর্মের পরিণাম অর্থাৎ বেদপ্রণোদিত কর্মফলের গূঢ় দিকটি বিশ্লেষণ করেন মহর্ষি কনাদ, যিনি বৈশেষিকসূত্রে বলিলেন—“যতোऽভ্যুদয় নিঃশ্রেয়সসিদ্ধিঃ স ধর্মঃ”। অর্থাৎ যাহা ইহলোকে অভ্যুদ্বয় (সমৃদ্ধি, কল্যাণ) এবং পরলোকে নিঃশ্রেয়স (মোক্ষ) প্রদান করে, তাহাই প্রকৃত ধর্ম। এইভাবে জৈমিনির প্রশ্নের পরিণত উত্তর খুঁজিয়া পাওয়া যায় কনাদের ভাষ্যরূপে। অতএব, পূর্বমীমাংসার ধর্মজিজ্ঞাসা ও বৈশেষিকের ধর্মসংজ্ঞা—এই দুই একত্রে ভারতীয় ধর্মতত্ত্বের গঠনমূল স্তম্ভ স্থাপন করিয়া থাকে।

তবে এই ধর্ম বা তার উৎসরূপ বেদ, কিংবা সেই বেদীয় চোদনা, প্রমাণহীনভাবে গ্রহণযোগ্য নহে। ঋষি গৌতমের ন্যায়সূত্র এইখানেই অপরিহার্য ভূমিকা গ্রহণ করে। তিনি বলিলেন—“प्रमाण-प्रमेय-संशয়…” ইত্যাদি দ্বারা, যে—সকল জ্ঞানতত্ত্ব, ধর্মবিচার, মুক্তিচিন্তা, কেবল তখনই গ্রহণযোগ্য যখনে তাহা প্রমাণ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। গৌতমের মতে, বেদও এক প্রমাণমাত্র—’শব্দ’-প্রমাণ; তবে তাহার গ্রহণযোগ্যতা যুক্তিপূর্ণ বিশ্লেষণের মধ্য দিয়াই নির্ধারিত হইবে। কারণ, অপ্রমাণিত শব্দ কিংবা অনিরীক্ষিত নির্দেশ কেবলমাত্র বিশ্বাসযোগ্য নহে; যুক্তি ও প্রত্যক্ষানুমানের দ্বারা তাহার প্রতিষ্ঠা আবশ্যক।

এইভাবে, যাহা জৈমিনি প্রশ্ন করিলেন, কনাদ তাহার গূঢ় পরিণতি নির্ধারণ করিলেন, এবং গৌতম তাহার যুক্তিগত সংহতি ও প্রমাণপদ্ধতি নির্ণয় করিলেন। কিন্তু এইসব চিন্তাতত্ত্ব, প্রমাণ, দর্শন, বিধি ও নিষেধ—সকলই কেবল তত্ত্বগত থাকিলে তাহার পরিণাম লাভ সম্ভব নহে। এই সকলের যথার্থ প্রতিফলন ঘটিতে পারে কেবলমাত্র এক শাসিত মানবসত্তায়, যাহার চিত্ত সংহত, সমবৃত্ত এবং নির্বিকল।

এইখানেই ঋষি পতঞ্জলি আবির্ভূত হন—যোগদর্শনের দ্বারা। তিনি বলেন—“योगश्चित्त वृत्ति निरोधः”—যোগ মানে চিত্তবৃত্তির নিষ্ক্রিয়া। যতক্ষণ চিত্তে বৃত্তি চলিতেছে, অর্থাৎ ভাবনার তরঙ্গ প্রাবল্য ধারণ করিতেছে, ততক্ষণ আত্মার স্বরূপ প্রকাশ হইতে পারে না। এই বৃত্তিনিরোধের ফলে যেই সমাধি, সেই সমাধি একমাত্র পথ যাহার মাধ্যমে চিত্ত শব্দ, ধ্বনি, প্রতিধ্বনি—সকল রূপ অভিব্যক্তি হইতে মুক্ত হইয়া এক অস্বর, অচল, নিষ্পন্দ অবস্থায় উপনীত হয়—সেই অবস্থাই সমাধি, যাহা অ-শব্দ, অবাক্য, নির্লিপ্ত চৈতন্যের বোধ।

এই সমাধিস্থ চিত্তই উপলব্ধি করিতে পারে ঋষি বিশ্বামিত্রের ঋগ্বেদীয় প্রেরণা“तत्सवितुर्वरेण्यम् भर्गो”—”সেই অনন্ত সৌরচেতনার উজ্জ্বলতা আমাদের অনুপ্রাণিত করুক”। তবে এই ‘প্রচোদয়াত্’ কেবল এক ঈপ্সিত অনুরোধ নহে—ইহা সেই পূর্ণত্বের আহ্বান, যাহা কেবলমাত্র সমাধিস্থ চেতনায় ধ্বনিত হয়। কারণ, যতক্ষণ চিত্তে বৃত্তি, শব্দ, অর্থ, উপলব্ধির বিভাজন রহে, ততক্ষণ সেই সব্যসাচী অনুপ্রেরণা—‘প্রচোদয়াত্’—নিবর্তিত হয় না।

এ বিষয়ে স্মরণীয় যে, পতঞ্জলির যোগ কেবল চিত্তনিগ্রহ নহে, ইহা এক বহুবিধ সাধনার সমন্বিত সংকল্প। পতঞ্জলি সংজ্ঞায় বলেন—“योगश्चित्तवृत्तिनिरोधः”—তবে এই নিগ্রহ কেবল মনোবৃত্তির নহে, বরং ইহা শরীর, প্রাণ ও মনোগতির পরিশুদ্ধ একীকরণ। এইখানে ‘যোগ’ শব্দটির যথার্থতা বিস্তৃত—ব্যায়াম অর্থে শরীরগত নিয়মিত অনুশীলন, আয়াম অর্থে প্রাণের প্রক্ষিপ্ত নিয়ন্ত্রণ (প্রাণায়াম), এবং আয়ন অর্থে মনোগতির সূক্ষ্ম ও সংহত অনুবৃত্তি—এই তিনের একত্র সাধনাই ‘যোগ’।

ভগবান বসুদেব কৃষ্ণ, যিনি এই ‘যোগ’ শব্দটিকে উপসম্পদা অর্থে ব্যবহার করেন। উপসম্পদা—অর্থাৎ সেই লাভ, প্রাপ্তি, আত্মসংপৃক্তি, যাহা দ্বারা মানব এক সর্ববেদ্য তত্ত্বে অংশলাভ করে। এই উপসম্পদাই ‘যোগ’-এর চূড়ান্ত রূপ—যোগ মানেই পারমার্থিকভাবে ঈশ্বর-সান্নিধ্যে প্রবেশ।

ঋগ্বেদে ঘোষিত—“यज्ञो वै विष्णुः”—ইহার দ্বারা প্রতিপাদিত যে, যজ্ঞই বিষ্ণু, এবং সেই বিষ্ণু নিজেই আত্মবিভক্ত হইয়া উপসম্পদা-রূপে জগতের দৃশ্য ও অদৃশ্য উভয় তলে আত্মপ্রকাশ করেন। এইভাবে বিশ্বজগত্‌ই এক বৃহৎ যজ্ঞ—নিত্য প্রবাহমান উৎসর্গপ্রতিসম্পাদনরূপ। তিনি প্রাণ স্বরূপে জীবদেহে প্রতিষ্ঠিত হন, যাহা সর্বপ্রাণীর মধ্যে সচেতনতা, জীবনতেজ এবং অভ্যন্তরীণ অনুপ্রেরণার আধার।

বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, বিষ্ণু নিজেকে বেদানুগ অনুপ্রেরণার মধ্য দিয়াও প্রতিষ্ঠিত করেন। নুপ্রেরণা (inspiration), প্রাণ (life-force), ও প্রমাতা (the knower)—এই তিনই বিষ্ণুর নিত্য লীলা, সেই কারণেই বিষ্ণুকে ত্রিবিক্রম বলা হইয়া থাকে। তিনি প্রমাতা রূপে চৈতন্য, প্রাণ রূপে গতিশক্তি, ও অনুপ্রেরণা রূপে শাস্ত্রবাক্যের অন্তর্নিহিত দিকনির্দেশনা স্বরূপ আত্মপ্রকাশ করেন। যাঁরা ভক্তি-সাধনার মাধ্যমে এই ত্রৈলোক্য লীলার অন্তরঙ্গ অংশ হইতে চাহেন, তাঁহাদের জন্যই এই বিষ্ণুলীলা শাশ্বত, সনাতন

এইখানে মীমাংসাকার বাদরায়ণ আবার স্মরণীয়—“अनावृत्तिः शब्दात् अनावृत्तिः शब्दात्”—বেদের বাণীবোধন অনুসারে, যিনি সেই চিরশ্রেয়স পদে উপনীত হন, তিনি পুনরাবৃত্ত হন না—তাহার আর পুনর্জন্ম নাই, আর বৃত্তির পুনরাগমন নাই, আর শব্দ-ভাবনা নাই। ইহাই ‘অনাবৃত্তি’। ইহা কেবল মোক্ষ নহে—ইহা বুদ্ধিবৃত্তি, শব্দবৃত্তি ও সচল চিত্তের সমস্ত প্রতিবিম্ব হইতে সম্পূর্ণ মুক্তি। এক অব্যক্ত, অস্বর, অশব্দ অবস্থান।

সেই ‘অশব্দ’ই ভারতীয় দর্শনের চূড়ান্ত পরিণতি, যাহা শ্রুতি, যুক্তি, প্রমাণ ও অভ্যাস—এই চতুরঙ্গ সাধনার মধ্য দিয়া উপলব্ধ হয়।

তন্ময় ভট্টাচার্য

রবিবার, ৬ জুলাই, ২০২৫

ইউরোপের মুক্তির উপপাদ্য: বন্দিত লোগোসের গ্রহণযোগ্যতা


Leave a Reply