সম্পাদকীয়
ভারত, চীন ও রাশিয়া—নতুন বিশ্ব অর্থনৈতিক ভারসাম্যের স্থপতি
শীতল যুদ্ধ-পরবর্তীকালে বিস্তীর্ণ কালপর্ব জুড়িয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল বিশ্ব অর্থনৈতিক রচনার অখণ্ড কাণ্ডারী, এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ছিল তাহার অনবদ্য প্রাবল্যের প্রধানতম পরিকাঠামো। ইহা কালের প্রবাহে একপ্রকার ভূ-রাজনৈতিক শৃঙ্খলা স্থাপনের শল্যচিকিৎসাসদৃশ অস্ত্র বলিয়া গণ্য হইত। কিন্তু বর্তমান বিশ্ব যে নব্য-বহুমুখী শক্তিসাম্য অভিমুখে দৌরাত্ম্য করিতেছে, সেই প্রেক্ষিতে ভারত, চীন ও রাশিয়ার ন্যায় রাষ্ট্রসমূহ আর কেবলমাত্র মার্কিন নিষেধাজ্ঞা সহ্য করিতেছে না—বরং তাহার কার্যকারিতাকে ক্রমশ নিষ্প্রভ করিয়া তুলিতেছে, বিশ্বক্ষমতার মানদণ্ড পুনঃসংজ্ঞায়নের পথ নির্মাণ করিতেছে।
এই মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আধিপত্যের অবক্ষয় কেবল আপাতদৃষ্টে কোন ঘটনাচক্র নহে, বরং বহুদিনের অন্তর্নিহিত গঠনগত পরিবর্তন, রাষ্ট্রীয় কৌশলগত পুনর্বিন্যাস, ও যুক্তরাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থার নিরপেক্ষতা লইয়া ক্রমবর্ধমান সন্দেহের পরিণত সঙ্কেত। একদিন যাহা ছিল নিষেধাজ্ঞার বলিষ্ঠ ভিত্তি—মার্কিন ডলারের সর্বব্যাপী প্রভাব—আজ তাহাই একমেবাদ্বিতীয়ম্ কেন্দ্রবিন্দু হইতে অপসারিত, যাহা বহুপাক্ষিক বিকল্পব্যবস্থার আকুল সন্ধানে পৃথিবীর বৃহৎ রাষ্ট্রসমূহকে অনুপ্রাণিত করিতেছে। ডি-ডলারাইজেশনের কৌশল, বিকল্প বাণিজ্যিক বন্দোবস্ত, ও সমান্তরাল আর্থিক পরিকাঠামোর বিনির্মাণের মাধ্যমে, যাহারা একদা নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্যভুক্ত ছিল, তাহারা আজ আত্মনির্ভরতায় দীপ্ত সাহসিকতা প্রকাশ করিতেছে।
এই নব সমীকরণের আলেখ্যে ভারতের অবস্থান বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। স্বনির্ভর কৌশলগত অটলতায় অভিষিক্ত এক উদীয়মান শক্তি হিশাবে, ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সহচরত্বকে কখনো দাসত্বে রূপান্তর করিতে সম্মত হয় নাই। ইউক্রেন সংঘাত-উত্তর কালে, পশ্চিমা শক্তির প্রবল চাপের বিরুদ্ধে ভারতের সুসংহত অবস্থান—বিশেষত রাশিয়ান অপরিশোধিত তেলের ব্যাপক আমদানী, রুপি-রুবল বাণিজ্যব্যবস্থার প্রবর্তন, ও রাশিয়ার সহিত প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে অবিচল সহযোগিতা—ইহা এক পরিণত পররাষ্ট্রনীতির নিদর্শন, যাহা জাতীয় স্বার্থকে মার্কিন-নির্ধারিত আখ্যান অপেক্ষা অধিক মূল্যবান গণ্য করে। CAATSA-র (Countering America’s Adversaries Through Sanctions Act) ছায়া হইতে ভারত পিছাইয়া যায় নাই—বরং রুশ S-400 ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ক্রয়ের মধ্য দিয়া যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চধ্বনি প্রত্যাখ্যান করিয়া কূটনৈতিক আত্মনিয়ন্ত্রণের সাহসী স্বাক্ষর রাখিয়াছে।
চীনের প্রতিরোধ ভারতের তুলনায় আরও সুদূরপ্রসারী ও প্রাতিষ্ঠানিক। বাণিজ্য, প্রযুক্তি, ও মতাদর্শিক মঞ্চে যুক্তরাষ্ট্রের সহিত দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতরত চীন, আমেরিকান আর্থিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে এক সুগঠিত ও বিকল্প আর্থিক পরিকাঠামো গড়িয়া তুলিয়াছে। SWIFT-এর বিকল্প স্বরূপ চীনের Cross-Border Interbank Payment System (CIPS), আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ইউয়ানের প্রমোচন, ও ইরান ও রাশিয়ার সহিত স্থায়ী বাণিজ্যিক সম্পর্ক—ইহা প্রত্যক্ষ করায় যে, চীন অর্থনৈতিক স্বার্থ ও ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্যকে মার্কিন শাস্তিমূলক হুমকির ঊর্ধ্বে স্থান দিয়াছে।
রাশিয়া, যাহা আধুনিক অর্থনৈতিক ইতিহাসে সর্বাধিক নিষেধাজ্ঞা-আক্রান্ত রাষ্ট্র, তাহা কেবল টিকিয়া থাকিয়াছে বলিলে তাহাকে ছোট করা হয়; বরং পশ্চিমা অবরোধকে সজ্ঞান কৌশলের দ্বারা পরাস্ত করিয়া, পূর্বমুখী শক্তিসঞ্চারে এক অনবদ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করিয়াছে। জ্বালানি রপ্তানি পুনর্মুখীকরণ, স্থানীয় উৎপাদনে আত্মনির্ভরতা, এবং সোনাদানা ও ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা-উপেক্ষামূলক লেনদেন—এই সকল উপাদান মিলে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা যদি বৈশ্বিক সমন্বয়ে অভাবগ্রস্ত হয়, তবে তাহা আত্মবিপর্যয়ের এক কারাগার ব্যতীত কিছুই নহে।
এই পরিবর্তনের পরিণাম গভীর ও বহুমাত্রিক। মার্কিন আর্থিক প্রভুত্বের ভিত্তি আজ অন্তঃসারশূন্য হইয়া পড়িতেছে। ডলারের সামরিকীকরণ বা “weaponization” বিপরীত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করিয়া বিকল্পব্যবস্থার প্রতি বিশ্বসমাজকে উৎসাহিত করিতেছে। BRICS আজ যৌথ মুদ্রার ধারণা বিবেচনা করিতেছে, শাংহাই সহযোগিতা সংস্থা স্থানীয় মুদ্রায় আন্তঃব্লক বাণিজ্যতৎপরতায় সহায়তা করিতেছে, এবং বহু দ্বিপাক্ষিক চুক্তি মার্কিন বহির্দেশী চাপ নিরসনের লক্ষ্যে আবদ্ধ হইতেছে। ইহা কোনো বিশৃঙ্খল ভাঙন নহে, বরং এক সচেতন ও বহুমাত্রিক নতুন ব্যবস্থার সূচনা।
এই রূপান্তর কেবল প্রযুক্তিগত বা অর্থনৈতিক নহে—ইহা জ্ঞানের প্রস্থানবিন্দুকেও স্পর্শ করিয়াছে। যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক অস্ত্রের মাধ্যমে যাহা নৈতিক আদেশরূপে চাপাইয়া দিতে চাহিয়াছিল, তাহা আজ বৃহৎ অংশের নিকট প্রত্যাখ্যাত। আনুগত্যের যুগ ক্ষীয়মাণ; ভীতিপ্রদর্শনের যুগ অন্তিম পর্যায়ে। ওয়াশিংটনের নিকট এই ক্ষণ এক গম্ভীর আত্মবিশ্লেষণের আহ্বান। বহুধামুখী, গতিশীল যুগে প্রাচীন কৌশলের উপর নির্ভরতা কেবল অচলাবস্থার লক্ষণই নয়—ইহা আত্মঘাতী নীতির নিদর্শন।
সুতরাং, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার শেষালোক কেবল মার্কিন প্রভাবের অবসান সূচিত করে না; কিন্তু তাহার একক কৌশলগত অধিকারের শেষনামা রচনা করে। যদি যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক নিয়মতান্ত্রিকতার উপযুক্ত নির্মাতা হইতে চাহে, তবে তাহাকে হুকুম থেকে সমঝোতায়, চাপ থেকে সহযোগিতায় যাত্রাপথ পরিবর্তন করিতে হইবে। অন্যথায়, তাহার আধিপত্য কেবল অপসারিত হইবে না—বিশ্বব্যবস্থা তাহাকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজনও বোধ করিবে না।
মঙ্গলবার, ৫ আগস্ট, ২০২৫