বাল্মীকি রামায়ণ বালকাণ্ড (সর্গ ১)

বাল্মীকি রামায়ণ

শ্রীমদ্বাল্মীকীয়রামায়ণে বালকাণ্ডে প্রথমঃ সর্গঃ

তন্ময় ভট্টাচার্য অনূদিত (সর্গ ১)

বালকাণ্ড

तपःस्वाध्यायनिरतं तपस्वी वाग्विदां वरम् ।
नारदं परिपप्रच्छ वाल्मीकिर्मुनिपुङ्गवम् ॥१-१-१॥

তপস্যা ও স্বাধ্যায়ে নিযুক্ত, তপোধন, বাক্‌বিদগ্ধদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, সেই মহর্ষি নারদকে একদিন বাল্মীকি ঋষি জিজ্ঞাসা করিলেন।

“কে ইহস্মিন্ সমসাময়িকে গুণবান্ ? কে বা বীর্যশালী? কে ধর্মজ্ঞ, কৃতজ্ঞ, সত্যবাক্‌, দৃঢ়ব্রত ?

চারিত্রে কে উত্তম? কে সমস্ত ভূতের প্রতি কল্যাণকামী ? কে বিদ্বান্ ? কে কার্যসম্পাদনে সমর্থ ? কে একমাত্র দর্শনেই প্রিয় ?

কে আত্মসংযমী ? কে ক্ৰোধজিত ? কে দীপ্তিমান্ ও অনসূয় ? যুদ্ধে কাহার রোষে দেবতাগণ ভীত হইয়া থাকেন ?

ইহা জানিবার প্রতি আমার বিশেষ কৌতূহল। হে মহর্ষে নারদ, আপনি ইহা জানিবার সমর্থ।

বাল্মীকির এই বাক্য শ্রবণ করিয়া, ত্রৈলোক্যজ্ঞ নারদ মুনি প্রসন্নচিত্তে কহিলেন— “শ্রবণ কর, আমি বলিতেছি।”

“যে গুণগুলি আপনি বলিলেন, ইহা দুর্লভ। তথাপি আমি বলিতেছি— এক পুরুষ এই সকল গুণে পরিপূর্ণ।”

ইক্ষ্বাকুবংশে জন্মগ্রহণকারী রাম নামে এক মহাপুরুষ আছেন— নিয়ত আত্মসংযমী, মহাবীর, দীপ্তিমান্‌, ধৈর্যবান্‌, ইন্দ্রিয়জিত।

তিনি বুদ্ধিমান্‌, নীতিজ্ঞ, বাক্‌পটু, সৌভাগ্যবান্‌, শত্রুনাশক। তাঁর স্কন্ধ বিশাল, বাহু দীর্ঘ, কন্ঠ শঙ্খের ন্যায়, চিবুক মহৎ।

বক্ষ সুদৃঢ়, ধনুর্বান্ধব, জঠর গূঢ়, শত্রুবিনাশী। বাহু আজানু, মস্তক সুঠাম, ললাট উন্নত, গতি উন্নত।

অঙ্গে সাম্য, বর্ণ কোমল, প্রতাপশালী। বক্ষ পীন, চক্ষু বিশাল, লক্ষ্মীসম্পন্ন, শুভ লক্ষণের অধিকারী।

ধর্মজ্ঞ, সত্যনিষ্ঠ, প্রজাকল্যাণে রত, যশস্বী, জ্ঞানসম্পন্ন, শুচি, নিয়মিত, একাগ্রচিত্ত।

প্রজাপতির তুল্য, শ্রীমান্‌, বিধাতা, শত্রুনাশক। জীবলোকে রক্ষক, ধর্মরক্ষায় নিরত।

নিজধর্মরক্ষক, আপনজনের রক্ষাকর্তা। বেদ ও বেদাঙ্গতত্ত্বজ্ঞ, ধনুর্বেদে প্রতিষ্ঠিত।

সমস্ত শাস্ত্রের তত্ত্বজ্ঞ (सर्वशास्त्रार्थतत्त्वज्ञो), স্মৃতিধারী, প্রজ্ঞাবান্‌, সর্বজনপ্রিয়, সদাচারী, দীনহীন, বিচক্ষণ।

সদাশয়দের নিকটে সদা প্রিয়, যেমন সমুদ্রে সকল নদী মিলিত হয়। আর্য, সর্বসমমতি, সদাপ্রিয়দর্শন।

এই সর্বগুণসম্পন্ন রাম, কৌশল্যার আনন্দবর্ধন। গাম্ভীর্যে সমুদ্রসম, ধৈর্যে হিমালয়ের তুল্য।

বীর্যে বিষ্ণুতুল্য, সৌন্দর্যে চন্দ্রসম, ক্রোধে মহাকালতুল্য, ক্ষমায় ধরাতুল্য।

দানশীলতায় কুবেরের তুল্য, সত্যে ধর্মতুল্য (सत्ये धर्म इवापरः)। এই সকল গুণে বিভূষিত রাম, সত্যপরাক্রমশালী।

তিনি শ্রেষ্ঠগুণে ভূষিত, শ্রেষ্ঠ পুত্র, দশরথপুত্র, প্রজাসমূহের হিতচিন্তক, জনকল্যাণে সদা প্রস্তুত।

তাহাকে প্রীতিসূচক যুবরাজপদে ( यौवराज्येन ) অধিষ্ঠিত করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন রাজা দশরথ

যখন অভিষেকের আয়োজন চলিল, কৈকেয়ী, পূর্বে প্রাপ্ত বরানুযায়ী, রামকে বনবাসে পাঠানো এবং ভরতকে অভিষিক্ত করিবার অভিলাষ প্রকাশ করিলেন।

সত্যবাক্য পালনের অঙ্গীকারে, ধর্মবদ্ধ রাজা দশরথ প্রিয় পুত্র রামকে বনবাসে পাঠাইলেন।

রাম, বীরপুরুষ, পিতার আজ্ঞানুবর্তনে, কৈকেয়ীর প্রীতিসাধনে, বনগমন করিলেন।

তাঁর পশ্চাতে অনুজ লক্ষ্মণ, মাতার আনন্দবর্ধক, স্নেহে ও বিনয়ে পূর্ণ, সহচর হইয়া চলিলেন।

ভ্রাতার প্রিয় ভ্রাতা হইয়া, ভ্রাতৃস্নেহের আদর্শে লক্ষ্মণ তাঁহার সহচর হইলেন।

রামের প্রিয় স্ত্রী সীতা, যিনি তাঁহার প্রাণের সমতুল্য, সদা সহচর, জনকের কুলে জন্মগ্রহণকারী, দেবমায়ার ন্যায় (देवमायेव निर्मिता) সৃষ্টি, সর্বলক্ষণসম্পন্না, নারীজাতির শ্রেষ্ঠা, উত্তমা গৃহিণী, রামের সহচরী হইলেন, যেমন রোহিণী চন্দ্রের সহচরী।

পৌরবৃন্দ ও পিতা দশরথ রামকে দূর পর্যন্ত অনুসরণ করিলেন। শৃঙ্গবেরপুরে রাম রথচালককে গঙ্গাতীরে বিদায় দিলেন।

তদনন্তর ধর্মনিষ্ঠ নিষাদকুলপতি গুহের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন।

গুহ, লক্ষ্মণ ও সীতার সহিত রাম গঙ্গার নিকটবর্তী অরণ্যে প্রবেশ করিলেন; বহু নদী পার হইয়া, চিত্রকূট পর্বতে মহর্ষি ভরদ্বাজের (भरद्वाजस्य शासनात्) উপদেশে আশ্রম স্থাপন করিলেন।

সেই স্থানে দেবগন্ধর্বসম রাম, লক্ষ্মণ ও সীতা সুখে বাস করিতে লাগিলেন। চিত্রকূটে রামের অবস্থানকালে দশরথ পুত্রবিচারে ক্লিষ্ট হইয়া স্বর্গে গমন করিলেন।

রাজার পরলোকগমনের পর, ভরত দ্বিজদের (वसिष्ठप्रमुखैर्द्विजैः) সহিত আসিয়া, রাজ্য গ্রহণে নিযুক্ত হইলেন; কিন্তু মহাবলীয়ান ভরত রাজ্য গ্রহণে অরাজি হইলেন।

তৎপর রামপাদপুষ্পসিক্ত করিবার উদ্দেশ্যে, ভ্রাতার সাক্ষাতে যাত্রা করিলেন।

ভ্রাতার নিকটে গিয়া, আর্যভাবযুক্ত (आर्यभाव) বাক্যে কহিলেন— “আপনিই রাজা, আপনি ধর্মজ্ঞ।”

তবে রাম, পরমৌদার্যশীল, সৌম্য ও মহাযশস্বী, পিতার আদেশ অমান্য করিলেন না; রাজ্য গ্রহণে অনিচ্ছা প্রকাশ করিলেন।

তিনি ভ্রাতার হাতে পাদুকা প্রদান করিয়া, রাজ্য তৎসঙ্গে অর্পণ করিলেন।

রাম তখন ভরতকে ফিরিয়া পাঠাইলেন। ভরত, ইচ্ছা অপূর্ণ হইয়াও, রামচরণ স্পর্শ করিয়া, নন্দিগ্রামে রাজ্যকার্য পরিচালনা করিতে লাগিলেন, রামাগমনের আশায়।

ভরত যখন অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন করিলেন, সেই সত্যনিষ্ঠ ও ইন্দ্রিয়জয়ী মহাত্মা রাম, নাগরিকগণের গমন প্রত্যক্ষ করিয়া, একাগ্রচিত্তে দণ্ডক অরণ্যে (বর্তমান ছত্তিশগড় রাজ্যের বাস্তার অঞ্চল) প্রবেশ করিলেন।

দণ্ডক অরণ্যে (অযোধ্যা হইতে দণ্ডকারণ্য 1,052.7 কিমি) প্রবেশ করিয়া, কমলনয়ন রাম, রাক্ষস বিরাধকে বধ করিলেন এবং তৎপরে মহর্ষি শরভঙ্গ দর্শন (शरभङ्गं ददर्श ह) করিলেন।

পরবর্তীকালে তিনি সুতীক্ষ্ণ, অগস্ত্য ও অগস্ত্যের ভ্রাতার সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। অগস্ত্যের বাক্য অনুসরণে তিনি ইন্দ্রের শার্ঙ্গধনু, এক বিশিষ্ট খড়্গ, ও অক্ষয় তূণীর লাভ করিলেন।

এইভাবে রাম যখন অরণ্যে বাস করিতেছিলেন, তখন বহু ঋষিগণ তাঁহার নিকটে আসিলেন, যাহারা অসুর ও রাক্ষসদের দ্বারা নিপীড়িত ছিলেন।

ঋষিদের অনুরোধে রাম, দণ্ডক অরণ্যে বাসকারী অগ্নিসম ঋষিদের রক্ষা করিবার জন্য, রাক্ষসবধের প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করিলেন।

তৎপর রামের সহিত সেই অরণ্যে (जनस्थाननिवासिनी) বসবাস করিতে করিতে, কামরূপিনী, বিকটাকারী রাক্ষসী শূর্পণখা অপমানিত হইল।

শূর্পণখার বাক্যে উদ্দীপ্ত হইয়া, সমুদয় রাক্ষস খর, ত্রিশিরা ও দূষণ যুদ্ধের জন্য আগমন করিল।

রাম যুদ্ধক্ষেত্রে উহাদের এবং উহাদের সহচরদের বধ করিলেন। উক্ত অরণ্যে অবস্থানরত জনস্থানবাসী চতুর্দশ সহস্র রাক্ষস রাম দ্বারা বিনাশিত হইল।

এইভাবে আত্মীয়বিনাশ সংবাদে, রাবণ ক্রোধে অচেতন (क्रोधमूर्छितः) হইয়া গেলেন। অতঃপর রাক্ষস মারি্চকে সহায়রূপে আহ্বান করিলেন।

মারীচ বহুবার নিষেধ করিলেও, রাবণ—কালবশীকৃত হইয়া—তাহার বাক্য উপেক্ষা করিলেন (अनादृत्य तु तद्वाक्यं )।

রাবণ ও মারীচ, রামের আশ্রমে উপস্থিত হইলেন। মারীচ দ্বারা রাম ও লক্ষ্মণকে দূরে সরাইয়া, রাবণ সীতাকে অপহরণ করিলেন এবং পাখি জটায়ুকে বধ করিলেন।

রাম যখন জটায়ুকে নিহত অবস্থায় দেখিলেন, এবং সীতাহরণের (मैथिलीम्) সংবাদ জানিলেন, তখন শোকবিহ্বল হইয়া বিলাপ করিলেন।

তৎপর, শোকসন্তপ্ত রাম জটায়ুর দাহক্রিয়া সম্পন্ন করিয়া, অরণ্যে সীতার অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন।

অনুসন্ধানে এক সময়ে বিকটদর্শন, বিকৃতরূপ, রাক্ষস কবন্ধের সাক্ষাৎ পান। মহাবাহু রাম তাহাকে বধ করিলেন এবং কবন্ধ স্বর্গে গমন করিল।

মৃত্যুকালে কবন্ধ রামকে জানাইলেন ধর্মপথনিষ্ঠা শবরি নামে এক শ্রামণী আছেন, তাহার সান্নিধ্যে যাত্রা করুন।

শত্রুনাশক রাম, মহাতেজস্বী, সেই শবরি আশ্রমে (श्रमणां धर्मनिपुणामभिगच्छेति) পৌঁছিলেন। শবরি রামকে যথাযথ পূজা করিলেন।

পম্পাতীরে (বর্তমান কেরালা) রাম বানর হনুমানের সঙ্গে মিলিত হইলেন (पम्पातीरे हनुमता सङ्गतो वानरेण ह)। হনুমান তাঁহাকে সুগ্রীবের সহিত মিলাইয়া দিলেন। [বানর মানে জঙ্গলে বসবাসকারী ব্যক্তি]

সুগ্রীবের সহিত সাক্ষাতে, রাম সমস্ত কথা বিবৃত করিলেন, বিশেষতঃ সীতাহরণের বিবরণ।

সুগ্রীব রামের কথাগুলি শুনিয়া অত্যন্ত প্রীত হইলেন ও অগ্নিসাক্ষ্যে বন্ধুত্ব সম্পাদন করিলেন।

বানররাজ সুগ্রীব, নিজের দুঃখের কথা রামের নিকট কহিলেন। রাম তাঁহার কথায় বালীবধের প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করিলেন।

সুগ্রীব বালীর শক্তি ও বীর্যের বিবরণ দিলেন। তথাপি সুগ্রীব রামের ক্ষমতা সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন।

রাম, তাঁহার প্রতাপ বোঝাইবার জন্য, মৃত দানব দুঃন্দুভির দেহ দশ যোজন দূরে পদাঙ্গুষ্ঠ দ্বারা নিক্ষেপ করিলেন।

এছাড়াও তিনি এক বানে সাতটি শালবৃক্ষ বিদীর্ণ করিলেন এবং পার্বতের গর্ভ পর্যন্ত বিঘ্ন করিয়া, সুগ্রীবকে বিশ্বস্ত করিলেন।

পরে সুগ্রীব অত্যন্ত আনন্দিত ও আত্মবিশ্বাসী হইয়া, রামকে লইয়া কিষ্কিন্ধা নগর অভিমুখে গমন করিলেন (হাম্পির উত্তর-পূর্বে অবস্থিত আধুনিক কর্ণাটক)।

তাহার পরে, স্বর্ণবর্ণবিশিষ্ট সুগ্রীব (हेमपिङ्गलः) অট্টনাদ করিলে, বালী (हरीश्वरः) সেই শব্দ শুনিয়া বাহিরে উপস্থিত হইলেন।

সুগ্রীব তারা নাম্নী স্ত্রীর অনুমতিতে বালীর সম্মুখে আসিলেন, এবং রাম তাঁহাকে একটিমাত্র বাণে নিধন করিলেন।

বালী বধ করিয়া, রাম সুগ্রীবকেই রাজ্যভার অর্পণ করিলেন।

তৎপর, বানরশ্রেষ্ঠ সুগ্রীব, সমস্ত বানরবাহিনীকে একত্র করিয়া, সীতার সন্ধানে চারিদিকে প্রেরণ করিলেন।

গৃধ্র সম্পাতির বাক্যে, বীর হনুমান, শত যোজন বিস্তৃত লবণসাগর সাঁতারে অতিক্রম (पुप्लुवे लवणार्णवम्) করিয়া, লঙ্কা নগর অভিমুখে গমন করিলেন।

সেখানে রাক্ষসশাসিত লঙ্কা নগর পৌঁছিয়া, তিনি অশোকবাটিকায় শোকমগ্ন সীতাকে (वैदेहीं ) দর্শন করিলেন।

সীতা , রামের প্রদত্ত অভিজ্ঞান পাইলেন, হনুমানের বার্তা শুনিলেন, এবং সামান্য আশ্বাসপ্রাপ্ত হইলেন। হনুমান তৎপর তোরণদ্বার বিনষ্ট করিলেন।

তিনি রাক্ষসসেনার পাঁচ অগ্রপতি, সাত মন্ত্রীপুত্র ও বীর অক্ষকুমারকে বধ করিলেন, অতঃপর বন্দী হইলেন।

পৈতামহ বরপ্রাপ্ত হনুমান, ব্রহ্মাস্ত্রবন্ধন সহ্য করিলেন, ইচ্ছানুযায়ী রাক্ষসদের দ্বারা বন্দী (নিজে থেকে) হইলেন।

তৎপর লঙ্কা নগরে অগ্নি সংযোগ করিয়া, সীতা ব্যতীত সকল স্থান দগ্ধ করিয়া, রামের বার্তা দিতে প্রত্যাবর্তন করিলেন।

হনুমান পুনরাগমন করিয়া, মহাত্মা রামের পরিক্রমা করিয়া, সীতাদর্শনের কথা বিস্তারিত বিবৃত করিলেন।

সুগ্রীব ও রাম একত্রে চলিয়া গেলেন মহাসমুদ্রের (महोदधेः) তীরে। রাম তখন সূর্যসম বাণ দ্বারা সমুদ্র উত্তাল করিলেন।

তাহার প্রভাবে নদীমাতার স্বামী সমুদ্র স্বয়ং আত্মপ্রকাশ করিলেন।

সমুদ্রের আদেশে নল নামে এক বানরসেনাপতি সমুদ্রের উপর সেতু নির্মাণ করিলেন।

সেই সেতুর সহায়তায় রাম বাহিনীসহ লঙ্কা নগরে প্রবেশ করিলেন এবং রাবণের সহিত মহাযুদ্ধ করিয়া তাহাকে বধ করিলেন।

রাম, সীতাকে পুনরুদ্ধার করিলেন, কিন্তু তখন তিনি প্রচণ্ড বেদনা ও সংকোচে আক্রান্ত হইলেন।

তিনি সীতাকে জনসমক্ষে কটুবাক্যে (परुषं जनसंसदि) অভিযুক্ত করিলেন, যাহা সহ্য করিতে না পারিয়া সতী সীতা অগ্নিতে প্রবেশ করিলেন।

অগ্নিদেবের ঘোষণায় জানা গেল— সীতা নিষ্কলঙ্কা। এই মহৎ কর্মে সীতা সমগ্র চরাচর জগৎকে সন্তুষ্ট করিলেন।

ঋষিগণ ও দেবতারা তাঁহাতে সন্তুষ্ট হইলেন; মহাত্মা রাম আনন্দিত হইলেন এবং সর্বদেবতারা তাঁহাকে পূজা করিলেন।

পরে রাক্ষসরাজ্যতে বিভীষণকে রাজা করিয়া, রাম নিজ কর্মে তৃপ্ত হইলেন এবং সংশয়মুক্ত হইয়া আনন্দ লাভ করিলেন (कृतकृत्यस्तदा रामो विज्वरः प्रमुमोद ह)।

দেবগণের বরপ্রাপ্ত হইয়া, আহত বানরবাহিনীকে উত্তোলন করিয়া, রাম পুষ্পক বিমানে চড়িয়া অযোধ্যার অভিমুখে যাত্রা করিলেন।

তাঁহারা পথিমধ্যে ভরতপত্নী আশ্রম তথা ভরদ্বাজের আশ্রমে পৌঁছিলেন। সেখান হইতে রাম, হনুমানকে ভরতের কাছে প্রেরণ করিলেন।

পরে রাম, সুগ্রীবসহ, অতীত ঘটনা পুনরুক্ত করিয়া, পুষ্পকে আরোহণ করিয়া নন্দিগ্রামে গমন করিলেন।

নন্দিগ্রামে পৌঁছিয়া, জটা ত্যাগ করিয়া, ভ্রাতৃদ্বয়ের সহিত শুচি হইয়া, সীতাকে লইয়া রাম পুনরায় অযোধ্যায় প্রবেশ করিলেন ও রাজ্য লাভ করিলেন।

তখন সমস্ত প্রজাগণ প্রফুল্লচিত্তে, আনন্দিত ও ধর্মনিষ্ঠ হইয়া উঠিলেন। সকলেই নিরোগ, দুর্ভিক্ষ ও ভয়হীন হইয়া জীবন যাপন করিতে লাগিল।

তখন কেহই পুত্রবিয়োগ দেখিল না, স্ত্রীরা সর্বদা সতী ও স্বামীসহ থাকিল। কেহ অগ্নিজ বা জলমগ্ন বিপদে পতিত হইল না, বাতজ বা জ্বরজনিত ভয়েও ছিল না।

ক্ষুধার্ত জন, ডাকাতির আশঙ্কা, নগরসমুহে ও রাজ্যে ধনধান্যের অভাব কোথাও ছিল না ( नगराणि च राष्ट्राणि धनधान्ययुतानि च)।

সমস্ত জনতা সর্বদা আনন্দিত ছিল, যেন কৃতযুগের পুনরাবর্তন হইয়াছে।

রাম শত শত অশ্বমেধ যজ্ঞ করিলেন, অগণিত সোনাদান করিলেন।

কোটি কোটি গরু দান করিলেন, শ্রদ্ধাপূর্বক বিদ্বান ব্রাহ্মণদের পূজা করিলেন। অসংখ্য ধন সম্পদ ব্রাহ্মণদের দান করিয়া, মহাযশস্বী হইলেন।

তিনি রাজবংশকে শতগুণে প্রতিষ্ঠা করিলেন এবং চতুর্বর্ণকে নিজ নিজ ধর্মে প্রতিষ্ঠা করিলেন (चातुर्वर्ण्यं च लोकेऽस्मिन् स्वे स्वे धर्मे नियोक्ष्यति)।

রাম দশ সহস্র বৎসর ও দশ শত বৎসর পর্যন্ত রাজত্ব করিয়া, ব্রহ্মলোকে (ब्रह्मलोकं) গমন করিলেন।

এই রামচরিত পবিত্র, পাপবিনাশী, পুণ্যময়, বেদানুকুল। যে ব্যক্তি ইহা পাঠ করিবে, সে সমস্ত পাপ হইতে মুক্ত হইবে।

এই রামায়ণ পাঠে, মানুষ, তাহার পুত্র, পৌত্র, আত্মীয়সহ, মৃত্যুর পর স্বর্গলোকে প্রতিষ্ঠিত হইবে (स्वर्गे महीयते)।

এই কাব্য পাঠে— ব্রাহ্মণ বাগ্মীতার অধিকারী হইবে, ক্ষত্রিয় রাজ্য লাভ করিবে, বৈশ্য ধনসম্পদ লাভ করিবে, শূদ্রও মহত্ত্ব অর্জন করিবে।

पठन् द्विजो वागृषभत्वमीयात् ।
 स्यात् क्षत्रियो भूमिपतित्वमीयात् ॥
 वणिक् जनः पुण्यफलत्वमीयात् ।
 जनश्च शूद्रोऽपि महत्त्वमीयात् ॥१-१-१००॥

বালকাণ্ড

ইতি শ্রীমদ্রামায়ণে বাল্মীকীয় আদিকাব্যে বালকাণ্ডে প্রথম সর্গ সমাপ্ত।


Leave a Reply