পল্লীগ্রামস্থ চৌকীদার নিয়মের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষীয় সভার আবেদন (1851)

Devendranath-Tagore

পল্লীগ্রামস্থ চৌকীদার বিষয়ক প্রস্তাবিত রাজ নিয়মের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষীয় সভার আবেদন: দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর

মহামহিম শ্রীযুক্ত ভারতবর্ষের কৌন্সেলের

সভাপতি মহাশ সমীপেষু

ভারতবর্ষীয় সভার আবেদন

১। বহু সম্মান পুরঃসর নিবেদন করিতেছি যে “বাঙ্গলা প্রভৃতি দেশে ডাকাইতি ও অন্যান্য অপরাধ অধিকরূপে দমন করিবার নিনিত্তে” যে রাজ নিয়মের পাণ্ডুলেখ্য প্রকাশ হইয়াছে, তাহা আমারদিগের বিবেচনায় নিতান্ত অহিতকারী এবং রাজনীতির বিরুদ্ধ। ইহাতে ভূম্যধিকারি ও অন্যান্য লোকের ন্যায্য অধিকার ও ক্ষমতার প্রতি অত্যাচার হইবার সম্ভাবনা। সম্পত্তি রক্ষার্থে যে কর সংগ্রহ হয় তাহা হইতে অথবা তাহাতে অকুলান হইলে সাধারণ রাজকর হইতে যে সকল ব্যয় নিষ্পন্ন হওয়া উচিত, প্রস্তাবিত এই রাজনিয়ম অনুসারে সেই সকল ব্যয় পূর্ব্বোক্ত ব্যক্তিরদের উপর অসহ্য ভার স্বরূপ পতিত হইবেক।

২। ডাকাইতি ও আর আর অত্যাচার সর্ব্বত্র বিশেযতঃ রাজধানীর নিকটস্থ সকল জিলাতে যেরূপ প্রবল হইয়া উঠিয়াছে, তাহাতে আমরা ও আর আর সকলেই নিতান্ত খিন্ন আছি। এইরূপ অত্যাচারে কতলোক আপনারদের পরিশ্রমের ফল হইতে বঞ্চিত হইতেছে ও দস্যুদিগের প্রতিরোধ করিবার উদ্যোগে শরীরে আঘাত পাইতেছে, আর কত লোকই বা ধন ও প্রাণ রক্ষা বিষয়ে সদা সশঙ্কিত আছে। কোন বিজ্ঞ রাজার অধিকারে এরূপ হইলে অত্যন্ত লজ্জার বিষয় হয়; কিন্তু প্রজার প্রতি ইংলণ্ডীয় রাজপুরুষদিগের যেপ্রকার যত্ন ও শান্তি রক্ষা জন্য যেরূপ বিপুল অর্থ সংগ্রহের উপায় আছে, ইহাতে তাঁহারদের শাসনে যে কি নিমিত্তে ভারতবর্ষে এরূপ অত্যাচার হইতেছে, তাহা আমারদিগের বুদ্ধির অগোচর।

আমরা অবগত আছি, যে শান্তিরক্ষার সম্বন্ধে যে সকল দোষ আছে, তাহা বহুকাল পর্য্যন্ত সর্ব্বসাধারণে বিদিত থাকায়, মান্যবর ডিরেক্টরেরা তাহা অবগত হইয়া তাঁহারদিগের এই অভিপ্রায় প্রকাশ করিয়াছিলেন, যে শান্তিরক্ষার উত্তম রূপ প্রণালী সংস্থাপন করিতে তাঁহারদিগের নিতান্ত ইচ্ছা। শ্রীলশ্রীযুক্ত গবরণর জেনরল বাহাদুরকে ইং ১৮৩৬ সালের ২০ জানুয়ারি তারিখে তাঁহারা যে পত্র লেখেন, তাহাতে এই উল্লেখ থাকে, যে ব্যয়ের আধিক্যতা জন্য পরাঙ্মুখ না হইয়া প্রজাদিগের ধন ও প্রাণ রক্ষার্থে শান্তিরক্ষার উত্তম প্রণালী সংস্থাপন করিবে। কিন্তু আমরা ইহাও অবগত আছি, যে অত্রস্থ গবরণমেণ্ট ইং ১৮৩৭ সালে পুলিস কমিটিকে শান্তিরক্ষার বিষয়ে যে সকল উপদেশ প্রদান করেন, তাহাতে তাঁহারদিগকে এই সতর্ক করিয়া দেন, যে যদি তাঁহারা শান্তিরক্ষার এমত কোন উপায় অবলম্বন করিবার জন্য অনুরোধ করেন, যে তাহাতে বিশেষ অধিক ব্যয়ের সম্ভাবনা, তবে তাঁহারদিগের সে অনুরোধ গ্রাহ্য হইবেক না। আর শান্তিরক্ষার নিমিত্তে যে কর সংগৃহীত হয়, যথাযোগ্য বিষয়ে তাহার সমুদয় নিযোজিত করিতে মান্যবর ডিরেক্টরদিগের কি অত্রস্থ গবরণমেণ্টের, কাহারোই এপর্যন্ত উদ্যোগ দেখিতে পাওয়া যায় না।

৩। আমরা এই আশা করিয়াছিলাম, যে ঘোরতর অত্যাচারের বৃদ্ধি দেখিয়া রাজপুরুষেরা অবশ্যই তাহার দমনার্থে বিজ্ঞ ও বহুদর্শি কর্ম্মচারিদিগকে স্থানে স্থানে প্রেরণ করিবেন, শান্তিরক্ষকের সংখ্যা বৃদ্ধি করিবেন, এবং অন্য অন্য উত্তম উপায় সকল স্থির করিবেন। কিন্তু এই রাজনিয়মের পাণ্ডুলেখ্য দেখিয়া সে সমুদয় আশা ভঙ্গ হইয়াছে। এই প্রস্তাবিত রাজনিয়ম অনুসারে ভূম্যধিকারিদিগের ন্যায্য অধিকার ও ক্ষমতার প্রতি অত্যাচার হইবে; এবং ন্যায়ানুগত বিবেচনা অনুসারে যে সকল ব্যয় তাঁহারদের উপর অর্শিতেপারে না, তাহার ভার তাঁহারদিগের উপর অর্পিত হইবে। এই সকল কারণ বশতঃ প্রস্তাবিত রাজনিয়ম সংস্থাপনের প্রতি আমারদের যে সকল আপত্তি, তাহা বিস্তারিতরূপে লিখিতেছি।

৪। উপস্থিত রাজনিয়মের এক স্থলে এই উল্লেখ আছে যে “ডাকাইতি ও অন্যান্য ভারি অপরাধ বাঙ্গলা দেশের ফোর্টউইলিয়ম রাজধানীর কতক জিলার মধ্যে পুনঃপুনঃ হুইয়া থাকে”। কিন্তু গবর্ণমেণ্ট এই সকল অত্যাচার দমন করিতে কি উপায় স্থির করিলেন। উপায়ের মধ্যে এই প্রস্তাবিত নিয়মের প্রথম প্রকরণে এই মাত্র বিধান আছে, যে ধৃত হইয়া যাহারদের দোষ সপ্রমাণ হইবে, পূর্ব্বাপেক্ষা তাহারদিগের প্রতি অধিক দণ্ড বিহিত হইবেক; এবং পূর্ব্বে যে কখন কোন ডাকাইতির দলে ভুক্ত ছিল, সে যাবজ্জীবনের নিমিত্ত দ্বীপান্তর গত হইবে। অন্য অন্য দেশের রাজনীতি শাস্ত্রে সুপণ্ডিত নিয়মকর্ত্তাদিগের দৃঢ় প্রত্যয় এই, যে অপরাধি ধৃত করণের ও তাহার দণ্ড বিধানের নিশ্চয়ত্ব থাকা কুকর্ম্ম দমনের যেমন উপায়, কঠিন দণ্ড বিধান করা সেরূপ কদাপি নহে। ইহার বিরুদ্ধে ভারতবর্ষের নিয়মকর্ত্তারা প্রাচীন কালের কুপ্রথার অনুবর্ত্তি হইয়া ভীষণ ও কঠিন রাজনিয়ম সকল প্রচলিত করিতেছেন; কিন্তু যাহাতে কুকর্ম্ম নিবারণ হয় এবং অপরাধিরা অপরাধের অব্যবহিত পরেই বিচারালয়ে আনীত হয়, তাহার কোন সদুপায় স্থির করিতেছেন না।

৫। সকলেরই এই নিশ্চয়, যে শান্তি বিষয়ক নিয়ম সংস্থাপন ও কর্ম্মচারি নিযুক্ত করণে রাজারদের এই প্রধান লক্ষ্য যে অত্যাচার নিবারণ হয়। দ্বিতীয় লক্ষ্য এই যে অত্যাচার নিবারণ না করিতে পারিলে অপরাধি নিশ্চয় ধৃত হয়। অপরাধিকে ধৃত করিয়া, পরে তাহার কুকর্ম্মের আনুসঙ্গিক বৃত্তান্ত অনুসন্ধান করা ও অপরাধ সাব্যস্ত হইবার প্রমাণ সংগ্রহ করা বিধেয়। এই সকল হইলে পর ধৃত ব্যক্তি যথার্থ অপরাধি কি না রীতিমত তাহা বিচার করা, ও অপরাধ সাব্যস্ত হইলে নিরূপিত দণ্ড বিধান করা যুক্তিসিদ্ধ।

অতএব দণ্ড বিধান করিতে হইলে তাহার অগ্রের সকল কর্ত্তব্য কর্ম্ম করা আবশ্যক এবং সেই সকল অগ্রের কর্ম্ম যথাযোগ্যরূপে সম্পন্ন হইবার উপায় না থাকিলে রাজনিয়মের কঠিনত্ব বৃদ্ধি করা নিরর্থক। ইংলণ্ডীয় রাজপুরুষেরা ভারতবর্ষ শাসনের পক্ষে উক্ত প্রণালী নিরবচ্ছিন্ন অবলম্বন করেন নাই। অত্যাচার রোধক শান্তিরক্ষকেরদের সংখ্যা অতি অল্প; পঞ্চক্রোশ ব্যাপি এক এক থানার অধিকারের মধ্যে এক জন করিয়া দারোগা ও দশ জন করিয়া বরকন্দাজ থাকিলে কোন প্রকারেই কর্ম্ম নিষ্পন্ন হইতে পারে না। জিলায় জিলায় যে সকল মাজিষ্ট্রেট নিযুক্ত হয়েন, তাহার মধ্যে অনেকেই অল্প বয়স্ক ও অনভিজ্ঞ এবং তাঁহারদের অভিজ্ঞতা জন্মিতে আরম্ভ হইলেই তাঁহারা অন্য কর্ম্মে প্রেরিত হয়েন। যেহেতু রাজস্ব সম্পর্কীয় কর্ম্মচারিদিগের বেতন অপেক্ষা তাঁহারদিগের বেতন অল্প।

জিলার সেশিয়ন আদালত হইতে ও সদর আদালত হইতে বিস্তর লোক নিরপরাধি সাব্যস্ত হওয়াতে সপ্রমাণ হইতেছে, যে অভিযোগের প্রচলিত পদ্ধতি পরিশুদ্ধ নহে। তথাপি গবর্নমেণ্ট শান্তিরক্ষকেরদের সংখ্যা ও বল বৃদ্ধি করিতে কিঞ্চিৎ মাত্র চেষ্টা পাইতেছেন না এবং এমন সকল অভিজ্ঞ ও কর্ম্মক্ষম মাজিষ্ট্রেট নিযুক্ত করিতে মনোযোগী হইতেছেন না, যাঁহারা আপনারদের অধীন কর্ম্মচারিদিগকে এমন আদেশ দিতে পারেন, যে তদ্দ্বারা অপরাধ প্রকাশ পায় ও অপরাধিরা দণ্ডনীয় হয়। যথাবিধি রূপে শান্তি রক্ষা না হইবার বিষয়ে গবর্ণমেণ্ট এই এক কারণ দর্শান, যে অর্থের নিতান্ত অসঙ্গতি। কিন্তু বোধ হয় আমরা সপ্রমাণ করিতে পারিব, যে শান্তি রক্ষা জন্য যে কর সংগৃহীত হয়, তাহা যথাযোগ্য রূপে নিযোজিত হইলে তৎসম্বন্ধীয় যাবতীয় বিষয় উত্তমরূপ সম্পন্ন হইতে পারে।

৬। রাজ নিয়মের বিরুদ্ধাচারি ব্যক্তিদিগকে যথার্হ কঠিন দণ্ড হইতে রক্ষা করিবার অভিলাষে অথবা রাজনীতি শাস্ত্রের সার মর্ম্ম প্রতিপন্ন করিবার অভিপ্রায়ে আমরা দণ্ডের কঠিনত্ব বৃদ্ধি বিষয়ে আপত্তি প্রকাশ করি নাই। নিয়ম কর্ত্তাদিগের নিকট আমারদের এই মাত্র আবেদন করিবার বাসনা, যে যদি তাঁহারা ভারতবর্ষের ভূম্যধিকারি ও প্রজাবর্গের মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাইতে চাহেন, যে নিশীথ সময়ের আক্রমণ হইতে তাহারদের শরীর ও সম্পত্তি রক্ষা করিতে তাঁহারদের যথার্থ যত্ন আছে, তবে শান্তি রক্ষার সুপ্রণালী সংস্থাপন করা এবং কর্ম্মদক্ষ ও ভূয়োদশী ব্যক্তিদিগকে মাজিষ্ট্রেটি পদে নিযুক্ত করা তাহার এক মাত্র উপায়; কেবল রাজ নিয়মের সংখ্যা বৃদ্ধি করিলে তাহা সুসিদ্ধ হইতে পারে না।

৭। পল্লীগ্রামের চৌকীদার বিষয়ক যে সকল নিয়ম প্রচলিত আছে, তাহার কোন কোন বিষয় পরিবর্ত্ত করিবার নিমিত্তে প্রস্তাবিত রাজনিয়মের পাণ্ডু লেখ্যের আর আর প্রকরণ সকল লিখিত হইয়াছে। পাণ্ডু লেখ্যের শিরোভাগে যাহা লিখিত হইয়াছে, অবশ্যই সেই উদ্দেশে ঐ সকল পরিবর্ত্তন করা হইয়াছে; কিন্তু আমারদিগের নিকট এই প্রকাশ পাইতেছে, যে কেবল ভূম্যধিকারিদিগকে চৌকিদার নিয়োজিত করিবার ক্ষমতা হইতে বঞ্চিত করিবার নিমিত্তে অথচ তাহারদিগের উপর ঐ সকল কর্ম্মচারিদিগের বেতন রূপ ভার অর্পণ করিবার নিমিত্তে এই সকল পরিবর্ত্তন হইয়াছে।

৮। মাজিষ্ট্রেট সাহেবেরদের হস্তে পল্লীগ্রামের চৌকিদার নিয়োজিত করণের ক্ষমতা অর্পণ করিবার নিমিত্তে এই প্রস্তাবিত নিয়মের দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রকরণে তিনটি কৌশল নির্দ্ধারিত হইয়াছে। যাঁহারদের চৌকীদার নিযুক্ত করিবার ক্ষমতা থাকিবেক, তাঁহারা সেই ক্ষমতানুযায়ী কর্ম্ম না করিলে প্রথম কৌশলানুসারে মার্জিষ্ট্রেট সাহেব চৌকীদার নিযুক্ত করিবেন। দ্বিতীয় কৌশল এই, যে যাঁহারদিগের চৌকীদার নিযুক্ত করিবার ক্ষমতা থাকিবে, তাঁহারা যদিও চৌকীদার নিযুক্ত করেন, তথাপি কোন কারণ প্রদর্শন না করিয়াও মাজিষ্ট্রেট সাহেবেরা সই নিয়োগ অগ্রাহ্য করিতে পারিবেন। যাঁহারা চৌকিদার নিযুক্ত করিবেন, তৃতীয় কৌশল অনুসারে, তাঁহারা দণ্ডনীয় হইবেন।

৯। ভূম্যধিকারিরা চৌকীদার নিযুক্ত করিতে অবহেলা করিলে মাজিষ্ট্রেট সাহেবেরদের চৌকীদার নিযুক্ত করিবার ক্ষমতা থাকিবে। এই প্রথম কৌশলে এই সিদ্ধান্ত স্থির করিয়া লওয়া হইয়াছে, যে চৌকিদার রাখিবার নিমিত্তে গবর্ণমেণ্ট ভূম্যধিকারিদিগের উপর বল প্রকাশ করিতে পারেন। ইহা অত্যন্ত আশ্চর্য্য, যে রাজপুরুষেরা পল্লীগ্রাম সমাজ বিষয়ে এত বাদানুবাদ করিয়াও এত ভ্রান্ত রহিয়াছেন। আরও আশ্চর্য্য এই, যে যে সকল রাজ নিয়ম অনুসারে পল্লীগ্রামস্থ চৌকীদারদিগকে নিয়মিত শান্তি-রক্ষকেরদের সাহায্য করিতে হয়, সেই সমুদায় রাজনিয়মেতেই এই কথার ঐক্য আছে, যে ঐ সকল চৌকীদার নিযুক্ত করা প্রজাদিগের স্বেচ্ছার অধীন।

যদি গ্রামস্থ লোকেরা বোধ করেন, যে চৌকিদার রাখিবার প্রয়োজন নাই, তবে ঐ সকল রাজ নিয়ম অনুসারে গবর্ণমেণ্টের এমন ক্ষমতা নাই, যে চৌকিদার নিযুক্ত করিবার নিমিত্তে বল প্রকাশ করেন। গবর্ণমেণ্টের যদি ঐ রূপ ক্ষমতা থাকিত, তাহা হইলে মফঃসলের কোন ধনবান্ লোক আপন গৃহ রক্ষার্থে চৌকিদার রাখিয়া পরে তাহারদের সংখ্যার ন্যূনতা করিতে অথবা একেবারে চৌকীদার না রাখিতে ইচ্ছা করিলেও ইংরাজি ১৮০৭ সালের ১২ আইনের ২১ প্রকরণের আভাস মতে রাজ্যের উপকারার্থে কতক চৌকীদার রাখিতেই হইত।

স্পষ্টই বোধ হইতেছে, প্রজাদিগের অধিকারের উপর এরূপ অত্যাচার করা গবর্ণমেণ্টের কখনই ইচ্ছা নহে। তবে যে এইক্ষণে রাজপুরুষেরা ভূম্যধিকারিদিগের ও তাঁহারদের প্রজাদিগের প্রতি ভিন্ন ভাব প্রকাশ করিতে উদ্যত হইয়াছেন, ইহা অতি আশ্চর্যের বিষয়। যেরূপ গৃহস্থের চৌকীদার কোন বিশেষ ব্যক্তির ভৃত্য, তদ্রূপ গ্রামের চৌকীদারেরা প্রজাদিগের ভৃত্য; বিশেষ কর্ম্ম গতিকে উভয়েই রাজনিয়ম অনুসারে শান্তি রক্ষক কর্ম্মচারিদিগের অধীন। পরন্তু আমারদিগের ইহা বোধ হইতেছে, যে গ্রামস্থ লোকেরদের হিতাহিত বিবেচনা করিয়া দেখিলে যে রাজনিয়ম অনুসারে গ্রামের চৌকীদারেরা কোন কোন বিষয়ে পুলিস দারোগাদিগের অধীন, সেই সকল নিয়ম রহিত করিলে ঐ সকল চৌকীদারদিগের কার্য্যকারিত্ব ও উপকারিতা বৃদ্ধি হইতে পারে। কারণ যদিও রাজকীয় কর্ম্মচারিরা এই পল্লীগ্রামের চৌকীদারদিগকে সর্ব্বদা অকর্ম্মণ্য বলিয় থাকেন কিন্তু তাহারদিগের অকর্ম্মণ্য হইবার কারণ যে তাহারদিগের প্রতি দারোগাদিগের অত্যাচার তাহা বিবেচনা করেন না।

যখন দারোগাদিগের ইচ্ছা হয়, যখন তাহারদিগের লাভের সময় উপস্থিত হয়, তখনই সেই চৌকীদারদিগের প্রতি হস্ত নিক্ষেপ করে। যে সকল বিষয় লিখিত হইল তদ্ব্যতীত ইহাও উল্লেখ্য যে চৌকীদারকে কর্ম্মে নিযুক্ত করিতে অবহেলা করা কি রূপে স্থির হইবে, ভূম্যধিকারিরা যে অবহেলা করিতেছেন তাহার সংবাদ তাঁহারা পাইবেন কি না, আর কত দিন পরেই বা মাজিষ্ট্রেট সাহেবেরা শূন্যপদে লোক নিযুক্ত করিতে পারিবেন,তাহার কিছুরই নিয়ম নির্দ্ধারিত নাই। এই সকল নিয়মের অভাবে ভূম্যধিকারিরা ও আর আর ব্যক্তিরা চৌকীদারের কর্ম্মে নিযুক্ত করিবার ক্ষমতা হইতে বঞ্চিত হইবেন; এবং পরিশেষে মাজিষ্ট্রেট সাহেবেরা চৌকীদার নিযুক্ত করিবার সম্যক ক্ষমতা গ্রহণ করিবেন।

১০। দ্বিতীয় কৌশল দ্বারা ভূম্যধিকারিরা স্ব স্ব ক্ষমতা হইতে যে বঞ্চিত হইবেন, তাহা স্পষ্ট প্রতীতি হইতেছে। ইহা উল্লেখ করা বাহুল্য, যে মাজিস্ট্রেট সাহেবেরা যদি সমুদয় চৌকীদার নিযুক্ত করিবার ক্ষমতা আপনারদিগের হস্তে আনিতে ইচ্ছা করেন,তবে ভূম্যধিকারিরা যে সকল চৌকীদার নিযুক্ত করিতে প্রস্তাব করিবেন, তাহাতে তাঁহারদিগের অসম্মতি প্রকাশ করিলেই হইবেক। যেহেতু এমন কোন নিয়ম নাই, যে মাজিষ্ট্রেটেরা প্রতিবার আপনারদের অসম্মতির কারণ লিখিবেন। তাঁহারা ভ্রান্তি পরবশ হইয়া যে সকল নিয়োগ অন্যথা করিবেন, উচ্চ পদস্থ রাজপুরুষদিগের নিকটে তাহার অভিযোগ করিবারও কোন নিয়ম নাই। আর ইহাও বক্তব্য, যে কোন কারণ বশতঃ মাজিষ্ট্রেট সাহেব কোন এক চৌকীদার নিযুক্ত করিলে সেই পদে চৌকীদার নিযুক্ত করিবার ক্ষমতা তাহারই চিরকাল থাকিবে কি ঐ পদ শূন্য হইলে ভূম্যধিকারী পূর্ব্ব ক্ষমতা প্রাপ্ত হইবেন, তাহা প্রস্তাবিত রাজ নিয়মের পাণ্ডুলেখ্যে উল্লিখিত হয় নাই। অনুমান হইতেছে, যে নিয়মকর্ত্তাদিগের এমন অভিপ্রায় নহে, যে এক বার কেহ চৌকীদার নিযুক্ত না করিলে চিরকালের নিমিত্তে সেই ক্ষমতা হইতে সে বঞ্চিত থাকিবে এবং চিরকালের নিমিত্তে মাজিষ্ট্রেট সাহেবেরা সেই পদে চৌকীদার নিযুক্ত করিবেন। কিন্তু সে বিষয়ে কোন স্পষ্ট বিধি না থাকিলে বাস্তবিক যে সেইরূপ হইয়া উঠিবেক, তাহা অনায়াসেই বুঝিতে পারা যাইতেছে।

১১। আমারদিগের বিবেচনায়, তৃতীয় কৌশল অনুসারে, কোন ভূম্যধিকারিই গ্রামের চৌকীদার নিযুক্ত করিতে অগ্রসর হইবেন না। ভূম্যধিকারির নিযোজিত কোন চৌকীদার ডাকাইতী করিয়াছে, যদি এমন সাব্যস্ত হয়; আর বিচারকালীন যদি এপ্রকার সপ্রমাণ হয়, যে কর্ম্মে নিযুক্ত হইবার পূর্ব্বে ঐ ব্যক্তির উপর ডাকাইতিতে যোগ থাকার সন্দেহ অনেকের ছিল, তবে এই প্রস্তাবিত নিয়মানুসারে ভূম্যধিকারির দুই শত টাকা দণ্ড হইতে পারে।

এইরূপ আশ্চর্য্য নিয়ম সকলেরই দৃষ্য বোধ হইবেক, সন্দেহ নাই। কিন্তু যখন এই নিয়ম প্রস্তাবিত হইয়া প্রকাশ পাইয়াছে, তখন অবশ্যই অনুমান করিতে হইবেক, যে ব্যবস্থাপক কৌন্সেল ইহাকে এরূপ দূষ্য বোধ করেন না। এইক্ষণে আমারদিগের বক্তব্য এই, যে মাজিষ্ট্রেট সাহেবেরা যে সকল থানাদার ও বরকন্দাজ নিযুক্ত করেন, যদি তাহারা নিযুক্ত হইবার পূর্ব্বে কোথাও ডাকাইতি করিয়াছিল কিম্বা পরে নিযুক্ত হইয়া কোন ডাকাইতির পোষকতা করিয়াছে, এমন সপ্রমাণ হয়, তথাপি তজ্জন্য তাঁহারা পদচ্যুত হয়েন না এবং তাঁহারদিগের জরিমানাও হয় না। আমারদিগের বোধ হয়, যে কোন দেশের নিয়মকর্ত্তার এমত সন্দেহও নাই, যে যাহারদিগের উপর কর্ম্মচারি নিযুক্ত করিবার ভার, তাহারা যোগ্যপাত্রকে কর্ম্ম না দিয়া অযোগ্য পাত্রকে দিবেক। অতএব ইহা আমারদিগের বুদ্ধির অগোচর, যে কি নিমিত্তে ভারতবর্ষের শাসনকর্তারা এই নিয়মের তৃতীয় ধারাতে এ প্রকার অন্যায় ও অযোগ্য সন্দেহ কল্পনা করিয়াছেন।

১২। ভূম্যধিকারিরা যাহারদিগকে চৌকীদারি কর্ম্মে নিযুক্ত করিয়াছেন, তাহারা পূর্ব্বে ডাকাইতি করিয়াছে, এমত কাহারও জ্ঞাতসার থাকিলে বা সন্দেহ হইলে তাঁহারা দণ্ডনীয় হইবেন। ইহা অত্যন্ত আশ্চর্য্যের বিষয়, যে যখন নিয়মকর্ত্তারা এই বিধান করিতেছেন, তখন এমন কোন নিয়ম করেন নাই, যে কোন ব্যক্তির জ্ঞাতসার ও সন্দেহ হইলে ভূম্যধিকারিদিগের দোষ সাব্যস্ত হইবেক। যদি রাজনিয়মের এমন মর্ম্ম হইত, যে ভূম্যকিকারিরা স্বয়ং জানিয়া অপরাধিদিগকে কর্ম্মে নিযুক্ত করিলে দণ্ডনীয় হইবেন, তাহা হইলে বাক্যবিন্যাস স্বতন্ত্র হইত এবং ঐ নিয়মের ন্যায়ানুগতত্বও থাকিত। কিন্তু যে ধারাতে জরিমানার কথার উল্লেখ আছে, তাহার যেরূপ বাক্যবিন্যাস, তাহাতে কেবল এই অর্থ নিষ্পন্ন হয়, যে ভূম্যধিকারিরা যে সকল নিয়োগ করিবেন, সেই নিযোজিত করিবার দশ বা বিংশতি বৎসর পরেও যদি কেহ শপথ করিয়া বলে, যে গ্রামের অমুক চৌকীদার কর্ম্মে নিযুক্ত হইবার দশ কি বিশ বৎসর পূর্ব্বে ভারতবর্ষের অমুক প্রদেশে ডাকাইতি করিয়াছিল, আমি জ্ঞাত আছি বা আমার এমন সন্দেহ হয়, তাহা হইলেই এই প্রস্তাবিত নিয়মের মর্ম্মানুসারে ভূম্যধিকারী দোষী হইবেন।

কাহারও অনিষ্ট করিবার মানস করিলে এদেশের লোকেরা তাহার উপর যখন কত প্রকার মিথ্যা অভিযোগ অক্লেশে উপস্থিত করে; অতি অল্প ব্যয়েতে যখন ইতর লোকদিগের মধ্যে হইতে এমন সকল লোক পাওয়া যায়, যাহারা সমুদার মিথ্যা কথা শপথ করিয়া বলে; এবং যখন রাজপুরুষেরা সেই সকল সাক্ষিদিগের কথাতে অনায়াসে বিশ্বাস করেন; তখন স্পষ্টই প্রতীয়মান হইতেছে, যে বিশেষ অনুসন্ধান করিয়া চৌকীদার নিযুক্ত করিলেও এই রাজনিয়ম অনুসারে ভূম্যধিকারিরা দণ্ডনীয় হইবেন। সুতরাং যৎ সামান্য বিষয় বুদ্ধি থাকিলেও তাঁহারা এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিবেন না; কারণ ইহাতে পূর্ধ্ব হইতে সাবধান হইবার কোন উপায় নাই।

সকলেই বিলক্ষণ অবগত আছেন, যে যাহারা পল্লীগ্রামের চৌকীদারি করে, তাহারা ইতর লোক; গবর্ণমেণ্ট কি ভূম্যধিকারিরা কখন এমত প্রত্যাশা করিতে পারেন না, যে সম্ভ্রান্ত শ্রেণীভুক্ত বিদ্বান লোকেরা চৌকীদারি কর্ম্ম স্বীকার করিবেন। ভূম্যধিকারিদিগকে আপনারদের অধিকারের মধ্যে অনেক চৌকীদার নিযুক্ত করিতে হয়। পূর্ব্বের রীতি চরিত্র জানা দূরে থাকুক, তাঁহারদিগের নিকটে সকলেই যে পরিচিত থাকিবে, তাহা কোন মতে সম্ভব নহে। সুতরাং তাঁহারদিগের জমিদারি সংক্রান্ত কর্ম্মচারিরা অথবা যে গ্রামে চৌকীদার নিযুক্ত করিতে হইবে সেই গ্রামের প্রজারা যে সকল ব্যক্তিকে নিযুক্ত করিতে কহিবে, তাহারদিগের কথায় বিশ্বাস করিয়া সেই সকল লোককেই নিযুক্ত করিতে হইবে। অতএব পল্লীগ্রামের চৌকীদারদিগের পূর্ব্ব চরিত্রের কোন দোষ প্রকাশ হইলে গবর্নমেণ্ট কি বিবেচনায় ভূম্যধিকারিদিগকে দায়ী করিয়া তাঁহারদিগের জরিমানা করিবার নিয়ম প্রস্তাব করেন, বরং প্রতিভূর ন্যায় তাহারদিগের ভাবি চরিত্রের দায়ী করিলে কতক সঙ্গত হইত।

১৩। রাজপুরুষেরা এমন কথা বলিলেও বলিতে পারেন, যে প্রস্তাবিত রাজনিয়মের যে ধারার কথা উত্থাপিত হইয়াছে, তাহার অর্থ এই, যে যাহারা প্রসিদ্ধ ডাকাইত বা যাহারদিগকে সকলেই সন্দেহ করে, তাহারদিগকে চৌকীদারি কর্ম্মে নিযুক্ত করিলে ভূম্যধিকারিরা দায়ী হইবেন। এই কথাতে ভূম্যধিকারিদিগের প্রতি এই দোষারোপ করা হয়, যে তাঁহারা আপনারদিগের কর্ত্তব্য কর্ম্মে এপ্রকার উপেক্ষা করেন এবং স্বস্ব মঙ্গল সাধনে এপ্রকার যত্নহীন হয়েন যে তাঁহারা প্রসিদ্ধ অপরাধিদিগকে প্রজাদিগের ধন প্রাণ রক্ষার্থে নিযুক্ত করিয়া থাকেন। সে যাহাহউক সে বিষয়ের বিশেষ উল্লেখ না করিয়া আমরা এই নিবেদন করিতেছি যে পূর্ব্বোক্ত অর্থ স্বীকার করিয়া লইলেও পূর্ব্বের ধারার সহিত ইহার অসঙ্গতি হয়। ঐ ধারাতে বিধান আছে, যে মাজিষ্ট্রেট সাহেবেরা ভূম্যধিকারিদিগের নিয়োগ অন্যথা করিতে পারিবেন!

মাজিষ্ট্রেট সাহেব যদি ভূম্যধিকারিদিগের নিয়োগকে সাব্যস্ত রাখেন, তবে অবশ্যই স্বীকার করিতে হইবে, যে সেই নিযুক্ত ব্যক্তিদিগের চরিত্রের প্রতি কোন সন্দেহ নাই। পুনর্ব্বার যদি চৌকীদারদিগের বিচারের সময় এমন সপ্রমাণ হয়, যে তাহারদিগকে অপরাধি বলিয়া সকলেই জানিত বা সন্দেহ করিত, তাহা হইলে স্বীকার করিয়া লওয়া হইল, যে জেলার তাবৎ লোকে যাহা অবগত ছিল যে মাজিষ্ট্রেট সাহেব উহারদিগকে কর্ম্মে নিযুক্ত করিবার বিষয়ে সম্মতি প্রকাশ করিয়াছেন, তিনি অবগত ছিলেন না; অথবা তিনি অবগত থাকিয়াও তাহারদিগকে নিযুক্ত করিবার বিষয়ে আপত্তি করেন নাই। ইহা হইলে এই বলা হয়, যে যাহারা বিখ্যাত অত্যাচারী তাহারা প্রায় ধৃত হয় না ও বিচারার্থে আনীত হয় না। এই নিয়ম যে প্রকারে বিবেচনা করা যায়, তাহাতেই ইহার দোষ প্রকাশ হয়।

১৪। এই রাজ নিয়মের পাণ্ডুলেখ্যের চতুর্থ ধারার স্পষ্ট লক্ষ্য এই, যে ভূম্যধিকারিদিগকে পল্লীগ্রামের চৌকীদার নিযোজিত করণ ক্ষমতা হইতে বঞ্চিত করিয়া কেবল উহারদের বেতনের ভার তাঁহারদের উপর রাখা হয়। আর আমরা ইহাও নিবেদন না করিয়া ক্ষান্ত থাকিতে পারি না, যে পল্লীগ্রামের চৌকীদারদিগকে যথা যোগ্য রূপে বেতন দেওয়া হইতেছে কি না, মাজিষ্ট্রেট সাহেবেরা তাহা কিরূপে স্থির করিবেন আর কিরূপেই বা উহারদিগের বেতন পাওনা থাকা নিরূপণ করিবেন, তাহার কোন বিধি উল্লিখিত হয় নাই। পরন্তু আমার দিগের বিশেষ নিবেদন এই, যে যাহারা বহুকাল পর্য্যন্ত চৌকীদারদিগের বেতন রূপ ভার বহন করিয়া আসিতেছে, নিয়ম কর্ত্তারা তাহারদিগের নিকট হইতে সেই ভার উত্তোলন করিয়া ভূম্যধিকারিদিগের উপর তাহা অর্পণ করিবার যে ক্ষমতা গ্রহণ করিতেছেন, তাহা ন্যায় বিরুদ্ধ।

এক শ্রেণীস্থ ব্যক্তির ভার আর এক শ্রেণীস্থ ব্যক্তির উপর কি নিমিত্তে অর্পিত হইতেছে, তাহার কিঞ্চিন্মাত্র কারণও প্রদর্শন করা হয় নাই। বস্তুত প্রজাদিগের দোষের নিমিত্তে ভূম্যধিকারিরা কি নিমিত্তে দণ্ডনীয় হইবেন, তাহার কারণ দর্শান নিতান্ত সহজ নহে। যদি ভূম্যধিকারিদিগের নিকট হইতে নিরূপিত রাজস্ব বৃদ্ধি করিবার অভিপ্রায়ে রাজপুরুষেরা এবিষয়ে যথেচ্ছাচার করিতে উদ্যত হইয়া থাকেন, তাহা হইলে আমারদিগের নিবেদন এই, যে দশশালা বন্দোবস্ত অনুসারে গবর্ণমেণ্ট তাহা কখনই করিতে পারেন না।

১৫। গূঢ় ভাবার্থ ঘটিত রাজনিয়ম সকল প্রচলিত হইলে আমারদিগের যত শঙ্কা হয়, স্পষ্টরূপে নির্দ্ধারিত রাজস্ব বৃদ্ধি করিবার উদ্যোগে আমারদিগের তত শঙ্কা হয় না। রাজকর্মচারিরা যে সকল বিবরণ প্রকাশ করিয়াছেন, তদনুসারে বাঙ্গালা দেশের ৩২ জিলাতে অনুমান ১,৬৯,২৪৩ জন চৌকীদার আছে এবং প্রত্যেকের মাসিক ৩ টাকা বেতনে প্রতি বৎসর ৬০,৯২,৭৪৮ টাকা ব্যয় হয়।

আমারদিগের বিবেচনায় পূর্ব্বোক্ত অনুমান ভ্রান্তি মূলক; কারণ আমরা অবগত আছি, যে প্রত্যেক গ্রামের চৌকীদার নিযুক্ত করিবার পদ্ধতি এবং তাহারদিগের বেতনের নিয়ম ভিন্ন ভিন্ন। পূর্বোক্ত রাজকীয় বিবরণ যথার্থই হউক বা ভ্রান্তি মূলকই হউক, স্পষ্টই দেখা যাইতেছে, যে উহার উপর নির্ভর করিয়া গবর্নমেণ্ট প্রস্তাবিত রাজনিয়মের বিধি সকল সংস্থাপন করিয়াছেন। আমারদের বোধে এই নিয়মের দ্বারা পল্লীগ্রামের চৌকীদারেরা ক্রমে ক্রমে এইক্ষণকার অকর্ম্মণ্য শান্তি-রক্ষকদিগের সহকারি হইয়া মাজিষ্ট্রেট সাহেবদিগের অধীন হইবে। শান্তি-রক্ষার নিমিত্তে গবর্নমেণ্ট যে কর সংগ্রহ করেন, তাহার যৎ কিঞ্চিৎ অংশ এইক্ষণে শান্তি-রক্ষকদিগের বেতনেতে ব্যয় হয়। এই প্রস্তাবিত রাজ নিয়ম অনুযায়ী ক্রমে ক্রমে এমন সকলও নিয়ম সংস্থাপিত হইতে পারে,যদ্দ্বারা চৌকীদারদিগের সাম্বৎসরিক সমুদায় বেতন ভূম্যধিকারিদিগের সদর জমার উপর বৃদ্ধি হইয়া গবর্ণমেণ্ট সেই যৎকিঞ্চিৎ ব্যয় হইতেও নিষ্কৃতি পায়েন। বাঙ্গলা দেশের ভূম্যধিকারিরা যে সকল প্রতিজ্ঞাকে অনুল্লঙ্ঘনীয় জ্ঞান করিয়া তাহার উপর নির্ভর করিয়া আসিতেছেন, এই প্রস্তাবিত রাজনিয়মকে আমরা তাহার প্রতিচ্ছেদক রাজনিয়ম সকলের অগ্রসর বোধ করিয়া অত্যন্ত শঙ্কাযুক্ত হইয়াছি।

১৬। চতুর্থ ধারাতে ইহাও লিখিত আছে, যে চৌকীদারেরা যদি বেতন না পায়, তবে তাহা আদায়ের নিমিত্তে দারোগারা ভূম্যধিকারি ব অন্য অন্য ব্যক্তিদিগের বিষয় ক্রোক করিতে পারিবেন। দারোগারদের উপর কোন ক্ষমতা অর্পিত হইলে তাহাতে যেরূপ অহিতাচার হইবার সম্ভাবনা, তাহা, সকলেই বিলক্ষণ অবগত আছেন। রাজপুরুষেরাও তাহা ভূয়োভূয়ঃ স্বীকার করিয়াছেন; আশ্চর্য্যের বিষয় এই, যে তথাপি তাঁহারা এমত নিয়ম সংস্থাপন করিতে চাহেন।

১৭। গ্রামে গ্রামে চৌকীদারের সংখ্যা কত হইবে আর তাহারদের বেতন কি পরিমাণে নিরূপিত হইবে, তাহা দ্বিতীয় ধারার শেষ ভাগে এবং চতুর্থ ধারার প্রথম ভাগে নির্দ্ধারিত হইয়াছে। এইরূপ নির্দ্ধারণ করাতে কল্পনা করিয়া লওয়া হইয়াছে, যে ভূম্যধিকারিদিগকেও প্রজাদিগকে অবশ্যই চৌকীদার নিযোজিত করিতে হইবে। এরূপ কল্পনা না হইলে এবিষয়ের উপর গবর্নমেণ্ট এপ্রকার বিস্তারিত রূপে কখনই হস্তক্ষেপ করিতে পারেন না। অন্য কোন প্রকার কর্ম্মচারি নিযুক্ত করিবার নিমিত্তে ও তাহারদিগের সংখ্যা ও বেতন নিরূপণ করিয়া দিবার নিমিত্তে পল্লীগ্রাম সমাজের উপর বল প্রকাশ করিলে যেরূপ অন্যায় করা হয়, এই রাজনিয়মের বিধান সকলও সেইরূপ অন্যায়, তাহা অপেক্ষা কোন অংশেই ন্যূন নহে। পল্লীগ্রাম সমাজের কিরূপ অবয়ব ও সেই সকল সমাজের ভৃত্য নিযোজিত হইবার কি বিধি, আমারদিগের বিবেচনায় রাজকর্ম্মচারিদিগের সে বিষয়ের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি না হওয়াতেই প্রস্তাবিত রাজনিয়মে এমন সকল বিধান লিখিত হইয়াছে।

১৮। প্রস্তাবিত রাজনিয়মের প্রতি আমারদিগের যে সকল আপত্তি, তাহা এই প্রদর্শন করিলাম। এই ক্ষণে,শান্তিরক্ষার নিমিত্তে যে সকল কর সংগৃহীত হয়, অথচ তদ্বিষয়ে তাহা নিযোজিত হয় না,তাহার বিবরণ করিতেছি। সকলেই বিশিষ্ট রূপে অবগত আছেন, যে যৎকালে ঈষ্টইণ্ডিয়া কোম্পানী দেওয়ানী গ্রহণ করেন, তৎকালে ভূম্যধিকারিরা শান্তি-রক্ষকদিগের বেতন বিষয়ে দায়ী ছিলেন। পূর্ব্বে শান্তি-রক্ষার্থে স্থানে স্থানে যে সকল ফৌজদার ও থানাদার নিযুক্ত থাকিত,তাহারদিগের বেতন দিবার নিমিত্তে “মশরূত থানাজাত” বলিয়া যে আড়াই লক্ষ টাকা, আর কেবল ফৌজদারদিগের জন্য “আবওয়াব ফৌজদারী” বলিয়া যে ছয় লক্ষ টাকা ছিল, তাহা গবর্ণমেণ্টের প্রথম বন্দোবস্তে জমা ভুক্ত হয়। এই বন্দোবস্ত অনুসারে দশ শালা বন্দোবস্ত হয়; সুতরাং পূর্ব্বোক্ত দুই অঙ্ক তাহার অন্তর্গত ছিল।

দশশালা বন্দোবস্ত পরে চিরস্থায়ী হয়। অপরন্তু প্রথম বন্দোবস্ত অপেক্ষা সদর জমা অনেক বৃদ্ধি হইবার পর চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়; সুতরাং বোধ হইতে পারে, যে আর আর অঙ্কের সহিত উল্লিখিত দুই অঙ্কও বৃদ্ধি হইয়াছিল। পরে এরূপ প্রণালীকে গবর্নমেণ্ট ভ্রান্তিমূলক ও অসভ্য নীতি কৌশলের আনুসঙ্গিক বোধ করিয়া, ইং ১৭৯৩ শালের ২২ আইনের দ্বারা তাহা রহিত করেন; আর ইং ১৭৯৩ সালের ১ আইনের ৮ ধারার ৪ প্রকরণে এই বিধান করেন, যে শান্তি-রক্ষকদিগের নিমিত্তে যে সকল ভূমির উপস্বত্ব নিয়োজিত আছে, তাহা শান্তি-রক্ষা কার্য্য নির্ব্বাহ নিমিত্তে বাজেয়াপ্ত হয়। আমরা অবগত হইয়াছি, যে এই নিমিত্তে বর্দ্ধমান ও হুগলি জেলার ভূম্যধিকারিরা পৃথক্ বা সদর জমার সহিত একত্রে রাজকোষে যে বার্ষিক কর প্রদান করেন, তাহা প্রায় এক লক্ষ টাকা।

ইং ১৭৯২ সালের ৭ ডিসেম্বর তারিখের গবর্নমেণ্টের অনুমতি অনুসারে যে “পুলিস টেক‍্স” নামে এক কর নির্দ্ধারিত হয়, তাহার পরিবর্ত্তে ইং ১৭৯৩ সালের ২৩ আইনে এই নিয়ম নির্দ্ধারিত হয়, যে শান্তি-রক্ষা সম্বন্ধীয় ব্যয় বাণিজ্য ব্যবসায়িরা সম্পন্ন করিবেন; কারণ শান্তি-রক্ষা উত্তমরূপ হইলে তাঁহারদিগেরই বিশিষ্ট উপকার, অথচ তাঁহারা তদ্বিষরক পৃথক্ কর দেন না! এরূপ বিধি হইবার আরও এক কারণ এই, যে ভূম্যধিকারিরা বন্দোবস্ত অনুসারেই শান্তি-রক্ষার নিমিত্তে সমধিক কর প্রদান করিতেছেন। কালেকটর সাহেবদিগকে গবর্ণমেণ্ট এই অনুজ্ঞা করেন, যে এই দুই প্রকার কর হইতে যে টাকা আদায় হইবে, তাহা “পুলিস কর” বলিয়া জমা হইবে।

ইং ১৭৯৭ সালের ৬ আইন অনুসারে ব্যবসায়িদিগের নিকট হইতে শান্তি-রক্ষা বিষয়ক কর সংগ্রহ করা রহিত হয়। আর “পুলিস টেক‍্স” রহিত করাতে শান্তিরক্ষা কার্য্য নির্ব্বাহ জন্য ব্যয়ের যে অকুলান হইবে, তাহা পূরণার্থে মোকদ্দমার খরচা না লইয়া ষ্টাম্প আইন প্রচার করা স্থির হয়। এই সকল হেতু বশতঃ আমরা নিবেদন করিতেছি, যে ষ্টাম্প করের মধ্যে যে অংশ ১৭৯৩ সালের ৩৮ আইন অনুসারে দেশীয় বিচারপতিদিগের নিমিত্ত এবং রাজ্যের সাধারণ ব্যয়ার্থে নিরুপিত আছে, তদ্ব্যতীত সমস্ত টাকা শান্তি-রক্ষা বিষয়ে নিযোজিত হওয়া উচিত।

রাজকীয় বিবরণে জ্ঞাত হওয়া যায়, ষ্টাম্প কর ২২ লক্ষ টাকা; আদায়ের খরচা এক লক্ষ টাকা বাদে ২১ লক্ষ টাকা হয়। যথার্থ বিবেচনা করিলে এই টাকার মধ্যে ন্যূনকল্পে ১৪ লক্ষ টাকা শান্তি-রক্ষা বিষয়ে নিযোজ্য। আমারদিগের আরও এই নিবেদন, যে ইং ১৭৯৩ সালের ৩৪ আইনের হেতুবাদে ইহা স্পষ্ট লিখিত আছে, যে “আবকারি টেক‍্স” কেবল রাজকীয় কর বৃদ্ধির নিমিত্তে নির্দ্ধারিত হয় নাই, অপরাধ নিবারণ কারাও ইহার এক উদ্দেশ; আর ইং ১৮০০ সালের ৬ আইনের ১৯ ধারাতে উল্লিখিত আছে, যে আবকারি টেক্‌সের দ্বারা পুলিসেরও সাহায্য হইবে। এমতে আবকারি বিষয়ে যে কর সংগৃহীত হয়, তাহার কতক অংশ শান্তিরক্ষা বিষয়ে নিযোজিত হইতে পারে। আমরা ইহাও নিবেদন করিতেছি, যে নদীর পারাপার ইত্যাদিতে যে সমধিক কর সংগ্রহ হয়, তাহা গবর্নমেণ্টের হিসাবে জমা না হইয়া নদীর উপর শান্তি-রক্ষা জন্য নিযোজিত হওয়া উচিত। ইহা হইলে শান্তি-রক্ষা বিষয়ক সাধারণ ধনের অনেক বৃদ্ধি হইবেক।

রাজকীয় বিবরণ অনুসারে নবদ্বীপ জিলার অন্তর্ব্বর্ত্তি সকল নদী হইতে খরচ খরচা বাদে গড় ১,৬৫,০৯২ টাকা কর সংগ্রহ হয়। আমরা ইহাও অবগত হইয়াছি, যে নবদ্বীপ জিলাতে গবর্নমেণ্ট সদর জমার প্রত্যেক টাকায় ৮ গণ্ডার হিসাবে পুলিস টেক্‌স অর্থাৎ শান্তি-রক্ষা বিষয়ক কর আদায় করিয়া থাকেন; ইহাতে ২০০০০ টাকা আদায় বোধ হয় এই প্রকার কর আর আর জিলাতেও পৃথক্ বা সদর জমা ভুক্ত হইয়া সংগ্রহ হয়। এমতে কেবল এই কর হইতে যে টাকা আদায় হয়, তাহাতেই শান্তি-রক্ষা বিষয়ের অনেক ব্যয় সম্পন্ন হইতে পারে। পরন্তু রাজকীয় বিবরণ অনুসারে, এক্ষণে শান্তি-রক্ষা বিষয়ে ৬,৬৩,২২০ টাকা প্রতি বৎসর ব্যয় হইয়া থাকে। অতএব এই সকল বিষয় পর্য্যালোচনা করিয়া দেখিলে স্পষ্ট প্রতীতি হইবে, যে শান্তি-রক্ষার্থ পূর্ব্বোক্ত বহুবিধ উপায়ের দ্বারা বর্ত্তমান ব্যয়ের অনেক গুণে অধিক যে কর সংগৃহীত হয়, তাহা যথাযোগ্য বিষয়ে নিযোজিত হইলে শান্তি-রক্ষকেরদের কার্য্যকারিত্ব ও উপকারিতা বৃদ্ধি হইবে; এক্ষণে যে সকল গুরুতর কুকর্ম্ম সর্ব্বদাই হইতেছে, সে সকল নিবারণ করিতে তাহারা ক্ষমবান হইবেক; এবং নিয়মকর্ত্তাদিগকে অন্যায় ও উদ্দেশ্য সাধনের অনুপযোগী রাজনিয়ম সকল সংস্থাপন করিতে হইবেক না।

১৯। অবশেষে আমারদিগের এই নিবেদন, যে লোকদিগের ধন ও প্রাণ রক্ষা করিবার যথাযোগ্য উপায় নির্দ্ধারণ করা যে গবর্নমেণ্টের অবশ্য কর্ত্তব্য কর্ম্ম, তাহাকরিতে যদি ইচ্ছা থাকে, তবে শান্তি-রক্ষা ও তৎ সদৃশ বিষয়ের নিমিত্তে যে সকল কর সংগৃহীত হইয়া অবৈধরূপে সাধারণ রাজকরে বিমিলিত হয়,তত্তৎ বিষয়ে তাহা নিযোজিত করিতে স্থির করুন; এবং বাঙ্গালা প্রভৃতি দেশের শান্তি-রক্ষা বিষয়ক যথার্থ অবস্থার অনুসন্ধান করিবার নিমিত্তে কতিপয় রাজকর্ম্মচারি, ভূম্যধিকারি, বাণিজ্য ব্যবসায়ী এবং আর আর উপযুক্ত ব্যক্তিদিগকে “কমিশনর” নিযুক্ত করুন। শান্তি-রক্ষার্থে কত কর সংগৃহীত হয়, বর্ত্তমান শান্তি-রক্ষা কার্য্যে কত টাকা ব্যয় হয়, এবং শান্তি-রক্ষকদিগের সংখ্যা ও বল বৃদ্ধি জন্য কত টাকা প্রাপ্তব্য, প্রথমতঃ ইঁহারা এই সকল স্থির করিলে, বাঙ্গলা দেশের প্রয়োজনোপযোগী শান্তি-রক্ষার এপ্রকার সুপ্রণালী স্থির করিতে পারিবেন, যে তাহাতে সাধারণ রাজ কর হইতে অধিক ব্যয় না হইয়া তদ্বিষয়ে নিযোজ্য ধন হইতে সমুদায় ব্যয় সম্পন্ন হইতে পারে। আমারদিগের নিবেদন এই, যে যেপর্য্যন্ত এমন সকল কমিশনর নিযুক্ত না হয় এবং নিযুক্ত হইয়া তাঁহারা যে পর্য্যন্ত এবিষয়ে গবর্নমেণ্টে রিপোর্ট না দেন,তত দিন গবর্নমেণ্ট প্রস্তাবিত রাজনিয়ম বা তত্তুল্য অন্য কোন নিয়ম প্রচলিত করা স্থকিত রাখুন।

শ্রীদেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
সম্পাদক।

১৮৫১

Devendranath-Tagore

Leave a Reply