গঠনের মুখে নূতন ভারত: বারীন্দ্রকুমার ঘোষ (১৯৩৬)

গঠনের মুখে নূতন ভারত: বারীন্দ্রকুমার ঘোষ

গঠনের মুখে নূতন ভারত

আত্মার এ দৈন্য কেন?

হিন্দু ভারতের যে প্রতিভা, যে সৃষ্টির মনীষা ও প্রাণধারা অর্দ্ধেক পৃথিবী জুড়ে এক দিন উপনিবেশ স্থাপন করেছিল বহু শতাব্দির পরাধীনতার চাপে সে মেধা ও প্রাণশক্তি ক্রমশঃ সঙ্কুচিত হয়ে এসেছিল। শুধু পরাধীনতাই এর কারণ নয়। আমাদের এই অনুপম কৃষ্টির যে ভারত তার আত্মার জীবনী-শক্তি স্বতঃই চলেছিল মৃত্যুমুখে—অবসাদ ও শুপ্তির পথে, অবশিষ্ট যা’ পড়েছিল তা’ হচ্ছে তার নিতান্তই প্রাণহীন জড় দেহ মাত্র। ব্যক্তি বল, জাতি বল, দেশ বল তার আত্মা থেকেই আসে যত সুষমা, শক্তি, সিসৃক্ষু ভাবধারা। আত্মা যার বিকাশের ধর্ম্ম ত্যাগ করে শ্রান্তি বশে চলেছে শক্তির অস্তাচলের দিকে তার জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে আসে জড়তা, কদর্য্যতা, নিস্পৃহা। জীবন ও মৃত্যু চিরদিনই চলে এমনই তরঙ্গে তরঙ্গে উঁচু নীচু বৃত্ত এঁকে এঁকে—সৃষ্টির নিয়মই যে এই। ভারতের এসেছিল সুষুপ্তির কাল, বিশ্রামের সময়;—তার যত কিছু পরাজয়, পরাধীনতা, দৈন্য ও বন্ধন, সে কেবল তারই অনিবার্য্য লক্ষণ।

মুসলমান ভারতও তার প্রেরণা ও কৃষ্টির মূল উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বহির্জগতের স্পর্শ হারিয়ে ক্ষয়ের পথ ধরেছিল। অতিভোগ ও যথেচ্ছাচারের অবসাদ ক্রমশঃ তার এই অবনতির গতি দ্রুত করে আনছিল। তাই প্রাচ্যে যখন উদিত হ’লো ব্রিটিশ শক্তির প্রখর সূর্য্য, তখন এই দুইটি মরণোন্মুখ কৃ্ষ্টি সেই জ্যোতির মাঝে সহজেই গেল ডুবে ম্লান হয়ে। তারা যে এক দিন ভারতের ছিল বিজেতা ও প্রভু, অতীতের এই ভুয়া গর্ব্ব ভারতের মুসলমানের মুখ ফিরিয়ে দিয়েছিল পাশ্চাত্যের সভ্যতার এই আলো থেকে তার বিপরীত দিকে। এই পাশ্চাত্য-বিমুখতা উপরন্তু ধর্ম্মের অন্ধ গোঁড়ামীর আকার নেওয়ায় ভারতের মুসলিম জনসাধারণ আজও এত অজ্ঞানে এত কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। ভগবানের প্রাণদায়ী জ্যোতি এ যুগে যে পথে যে রূপ নিয়ে আসছে, সে হচ্ছে পাশ্চাত্যের জ্ঞান, বিজ্ঞান, ওদের অপূর্ব্ব কর্ম্ম ও গঠন কুশলতা; আজ সুতরাং এই দিক থেকে যে জাতি মুখ ফেরাবে তার প্রগতি ও কৃষ্টির মৃত্যু ও ক্ষয় অনিবার্য্য।

আজ হিন্দু-ভারতেরও বোঝবার দিন এসেছে, যে, দেশের মুসলিম প্রজা সাধারণের মাঝে এই যে আধুনিক শিক্ষা দীক্ষা ও সংস্কৃতির অভাব, ভারতের পক্ষে এর চেয়ে অকল্যাণের দ্বার— অশিবের গোমুখী উৎস আর কিছুই নাই। গণ-চৈতন্য হচ্ছে সহজেই মূক, স্বভাবতঃই অন্ধ ও পশু-ধর্ম্মী; শাসক সম্প্রদায় ও দেশবাসী যদি সে মূঢ় মূক মনকে শিক্ষায় দীক্ষায় চেতন, সংস্কৃত ও উদার করে না নিতে পারেন ত’ হ’লে এই সঙ্কীর্ণ স্বার্থ—দুষ্ট অন্ধ পশু-মন ভাবী যুক্ত-ভারতের সব পরিকল্পনা সব গঠনই বার বার নষ্ট করে দেবে।

ধর্ম্মান্ধ ভারত, তা’ হিন্দুই হোক আর মুসলমানই হোক, সে যত দিন সম্প্রদায়িকতার ধর্ম্মকে জাতীয় জীবন থেকে দূরে ব্যক্তিগত জীবনের পরিধির মাঝে না রাখতে শিখবে, দেশের রাজনীতিকে এই ধর্ম্মান্ধতা রাহুর গ্রাস থেকে মুক্ত করতে না পারবে, তত দিন স্বরাজের কোন আশাই নাই। যদি বা কোন গতিকে স্বরাজ লাভ ঘটে তা’ হ’লে জাতিকে ভ্রাতৃঘাতের দুস্তর রক্ত-নদী পার হয়ে সে স্বরাজ পেতে হবে। বহিরঙ্গ আনুষ্ঠানিক ধর্ম্মের গোঁড়ামী অজ্ঞ সহজ-বিশ্বাসী গণশক্তির হাতে চিরদিনই লঙ্কাদাহের মশালে পরিণত হয়। একথা বলে কোন লাভ নেই, যে, বিদেশী শাসক সম্প্রদায়ই এই সম্প্রদায়িকতার আগুনে ইন্ধন জোগান। জাতির রক্তে যে বিব আছে, যে কোন উত্তেজক কারণ তার বহিঃ-প্রকাশ আনবেই। আমাদের জাতীয় যজ্ঞের পুরাতন নেতাদের অনেকেই অল্প বিস্তর এই বিষ অন্তরে পোষণ করেন। তাঁদের অনেকেই ভুলতে পারেন না, যে, তাঁরা হিন্দু বা মুসলমান, কারণ শুধু বাহিরেই নয় তাঁদের মনেরও গজিয়েছে টিকি এবং দাড়ী। তাঁদের চোখে আগে পড়ে হিন্দু বা মুসলমান, ব্রাহ্মণ বা শূদ্র, মুচী বা মেথর, পরে অনেক করে ভেবে চিন্তে তবে বুঝতে পারেন ওরা মানুষ, ওরা ভারতবাসী। সঙ্কীর্ণ অনুদার সমাজ ও ধর্ম্মের বশে আমরা বহু কাল থেকে মানুষকে মানুষ বলে চিনতে ভুলে গিয়েছি।

আধুনিক তরুণ তুর্কীর জন্মদাতা কেমাল যে অসির মুখে এই অপধর্ম্মের আগাছাকে জাতীয় জীবন থেকে উন্মূলিত করে ফেলে দিয়ে জাতিকে সুস্থ নিরাময় করেছেন সে কি মিছে? সোভিয়েট রাশিয়ার তরুণ মন আজ যে নিরীশ্বরবাদী তার কি কোন কারণ নাই? এই যদি ভগবান হয়, ধর্ম্ম হয়, যা’ অশিক্ষিত ধর্ম্মান্ধ জনতার মুখে তোমাকে আমাকে বলে হত্যা করতে, ঘরে ঘরে আগুণ দিতে, নারীর সতীত্ব নাশ করতে, লুণ্ঠন করতে, শিশু ও নারী বধ করতে একটা তুচ্ছ গাভীর জন্য, ইটপাটকেলে গড়া তুচ্ছ মন্দির বা মস্জি‌দের সামনে গীত বাদ্যের জন্য তা’ হলে সে ধর্ম্ম সে ভগবান যে সয়তানের ফাঁদ তাতে আর সন্দেহ কি? সভ্য ও শিক্ষিত মানুষ—তা’ সে হিন্দুই হোক বা মুসলমানই হোক, অপধর্ম্মের এ জাঙ্গাল রাখবে না, এক দিন ধূলিসাৎ করে দেবেই। ভারতের বাহিরের জীবন্ত মুসলমান ও খৃষ্টান দেশগুলি এ জঞ্জাল ক্ষিপ্র হস্তে দূর করছে, হিন্দু ও মুসলমান ভারতকেও বাঁচতে হলে শীঘ্র হোক বিলম্বে হোক তা’ করতে হবে। ধর্ম্মান্ধের স্বরাজ নাই, জাতি বা শ্রেণী বিদ্বেষের যে পূজারী তার মুখে মুক্তির বাণী শোভা পায় না। ভারতে ধর্ম্ম-বিদ্বেষ প্রচুর আছে, তার সঙ্গে জাতি-বিদ্বেষ, শ্রেণী-বিদ্বেষ, বর্ণ-বিদ্বেষ জুটে জাতির স্বাস্থ্য নষ্ট করে আনছে। তাই আগে জাতির অন্তঃশুদ্ধি তার পরে স্বরাজ, আগে সংগঠন তার পরে মুক্তি। আগে ঐক্য তারপরে স্বরাষ্ট্র রচনা। আমরা এত দিন এর বিপরীত প্রচেষ্টাই করেছি, অন্তরের দিকে চক্ষু মুদে বাহিরকে গুছাতে চেয়েছি, তাই পদে পদে ঘটেছে এত পরাজয়, এত ব্যর্থতা। ভারতের শত্রু বিদেশী নয়, বাহিরের কাহারও দেওয়া শিকল নয়, ভারতের প্রকৃত শত্রু, আসল বন্ধন ও দৈন্য আমাদের অন্তরে।

গঠনের অন্তরায়—

রাজনীতিক বা জাতীয় ঐক্য সহজে আসে না। য়ুরোপকে আমরা সভ্য মনে করি, তারা আমাদের মত পরাধীন নয়, তবু সেই য়ুরোপে মুসোলিনী, হিটলার, লেনিন ও ষ্ট্যালিনের মত ডিক্টেটর আবশ্যক হয় জাতির গঠন-পরিকল্পনায় ও কাজে ঐক্য আনতে—সেই ঐক্যকে কার্য্যকরী করতে। মূক অন্ধ গণশক্তিকে কল্যাণমুখী করবার জন্য ডিমোক্র্যাশীতে কুলায় নাই, সেই অতি-পুরাতন অটোক্র্যাসী নূতন মুখোস পরে কাজে নেমেছে; তবে এসেছে সংহতি, ঐক্য, শৃঙ্খলা। বিধিপ্রেরিত ইংরাজ গুরুর কাছে রাজনীতি ও কর্ম্ম-কৌশল শেখা আমাদের কাছে তিক্ত ও অপমানকর মনে হয়, অথচ কি কংগ্রেসে আর কি আধা-সরকারী গোল টেবিলের কন্‌ফারেন্সে সম্মিলিত জাতীয় নেতাদের একযোগে কাজ করবার কোন সামর্থই দেখা যায় না। স্বরাজের ফেডারালী খস্‌ড়া গড়তে বসে ভারতের হিন্দু মুসলমান নেতারা নিজেদের মধ্যে কোন ঐক্যই খুঁজে না পেয়ে প্রধান মন্ত্রী ম্যাক্‌ডোনাল্ড সাহেবকে ধরে পড়লেন একটা যা’ হোক সরাসরি বিধান দিয়ে দিতে।

আসলে আমরা বাগবিতণ্ডার রাজনীতি, ভাগবাঁটোয়ারার রাজনীতি অনেক করেছি, যা’ আছে তা’ নষ্ট করবার রাজনীতি অনেক নেড়েছি, কিন্তু কাজের রাজনীতি আদৌ করি নাই। অথচ গঠনের আদর্শ নিয়ে জাতি গড়তে নামলেই তবে জাতিতে জাতিতে সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে ঘুচবে এই অপ্রীতি ও অবিশ্বাস, হানাহানির হট্টগুলে রাজনীতিতে তা মোটেই ঘুচবে না। যেটুকু গঠন আমরা এপর্য্যন্ত ভেবেছি বা করেছি তা’ শুধু লোক-দেখানো আন্দোলন হিসেবে, রাজনীতিক চাল হিসেবে। আমরা স্বদেশী করেছি ইংরাজকে ভাতে মারতে, মদ ছেড়েছি ইংরাজের আবগারী অচল করতে। জেলে গেছি ইংরাজের মাথা হেঁট করতে, নগ্ন নিরন্ন দেশবাসীর অন্নবস্ত্র যোগাতে নয়, কর্ম্মবিমুখ দেশকে কৃষি বাণিজ্য শেখাতে ও মানুষ করতে নয়। আমরা এসেম্‌ব্লিতে কাউন্সিলে গেছি নূতন বিধি ব্যবস্থা গড়ে জাতির অশিক্ষা ও দৈন্য ঘুচাতে নয়, ইংরাজের শাসনচক্র কাণা করতে। আমাদের কর্ম্মের পুঁজি ও প্রেরণা দেশপ্রীতি তত নয়, জাতি-বিদ্বেষ যত। যদি গঠনের কাজে আমরা সেই নেতাদের লাগাই যাঁরা মানুষ হয়েছেন বক্তৃতা-মঞ্চে ও সুলভ মাল্য করতালির মাঝে, যদি আমরা জাতীয়তার বাহন করি সেই কর্ম্মীদলকে যারা নিজেরাই গড়ে উঠেছে মিটিং ও শোভাযাত্রার ফাঁকা ভাববিলাসে, তা হলে সে গঠন-যজ্ঞ পণ্ড হবে তাতে আর আশ্চর্য্য কি? আমাদের কংগ্রেসী স্বদেশী, রাজনীতিক চাল হিসেবে ঐ ভূয়া পল্লীগঠন ও দলিতোদ্ধার করা হয়েছে নিতান্তই আনাড়ী ভাবে যা তা উপকরণ নিয়ে। কারণ এ কাজগুলো ছিল গৌণ কাজ—ফাঁকি দিয়ে চাল মেরে স্বরাজ প্রাপ্তির সহজ উপায় মাত্র; এ আমাদের মনের কথা নয়।

শুধু কি তাই? পরাধীন দেশের রাজনীতি কিঞ্চিদধিক সংঘর্ষ মূলক হবেই। দু’টো আপাতবিরোধী স্বার্থের যেখানে চলেছে টানাটানি, টাগ্ অব্ ওয়ার্ সেখানে রাজনীতিক নেতারা রয়েছেন একটা হানাহানির অনিশ্চয়তার মাঝে। তাঁরা এত বড় দরিদ্র দেশের শিক্ষা, কৃষি, বাণিজ্যকে তুলবেন কি করে? স্বরাজই যখন জাতির সকল দৈন্য অপনোদনের সেরা উপায়, সহজ মুষ্টিযোগ, তখন এসব দিকে মন দেবার তাঁদের অবসর বা মতি গতি কোথায়?

জাতি গঠনের ভিত পাকা বনিয়াদের উপর গড়তে হ’লে আমাদের চাই জাতীয় তর্কমহাসভা রূপ কংগ্রেস নয় কিন্তু গঠনমূলক মনোবৃত্তির কার্য্যকরী কংগ্রেস যা’ জাতীয় জীবনের দিকে দিকে গঠনের সুষ্পষ্ট পরিকল্পনা স্থির করে তা’ কাজে কর্ম্মে হাতে কলমে সফল করবার উপায় ও ব্যবস্থা করবে। একটি বড় গোছের বাৎসরিক ডিবেটিং সোসাইটি, আলোচনা সভা যা’ কেবল চুলচেরা যুক্তিজালে ধুরন্ধর, কথা ও বাকবিতণ্ডার জন্য জিহ্বাকণ্ডুয়ন যার অত্যধিক, সে কংগ্রেস জাতিকে ভাবে নাচাতে পারে, কাজে নামাবে কি করে? আমরা চাই সত্যকার কর্ম্মীর কংগ্রেস; ব্যবসায়ে, বাণিজ্যে, কৃষিতে, শিল্পে অর্থনীতিতে, রাজনীতিতে এমন কৃতী মানুষ ও বিশেষজ্ঞের কংগ্রেস যাঁরা বড় বড় কার্য্যকরী প্রতিষ্ঠান নিজের হাতে গড়ে তুলেছেন, তা’ নিয়মিত ও পরিচালিত করে অভিজ্ঞ হয়েছেন। যখনই জাতির কোন সমস্যা সঙ্গীন হয়ে ওঠে তখনই গভর্ণমেণ্ট বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেন, তারা কমিটিতে বসে গড়ে দেয় সুষ্ঠু ও সুস্পষ্ট পরিকল্পনা, গভর্ণমেণ্ট তা’ বিধিবদ্ধ করে কাজে ফলাতে চেষ্টা করেন। দেশে পল্লী স্বাস্থ্য, শিল্প-সংগঠন, শিক্ষা বিস্তার, কৃষি-ঋণ, সমাজ সংস্কার সবই অল্প বিস্তর গভর্ণমেণ্ট করেছেন এবং করছেন।

আমরা কিন্তু সেই সব সমস্যা নিয়ে চুল-চেরা আলোচনায় ও বাগবিতণ্ডায় শুধু কলহ ও অনৈক্য ঘনিয়ে তুলছি, তার পর মহাত্মাজী বা আর কারও শরণাপন্ন হচ্ছি একটা যা হোক সমাধানের জন্য। দেশের জনবল ধনবল আছে সংগৃহীত হয়ে যে গভর্ণমেণ্টের হাতে ও যে ব্যবস্থা পরিষদের হাতে, তাকে আমরা অস্পৃশ্য করে রেখে বাঁচাতে চাই অসহযোগী কংগ্রেসের ভূয়া প্রেষ্টিজ, আর সরকারী পরিকল্পনাকে গালি দিই eye-wash বলে। এই যদি জাতীয় আন্দোলন হয় তা’ হলে সে জাতির কল্যাণ সুদূর–পরাহত, কারণ সে জাতি আপন ধনবল জনবল থেকে আপন শক্তি ও ঐশ্বর্য্যের ঘর থেকে বিবাগী ও বনবাসী হয়েছে মনের দুঃখে ও ব্যর্থ অভিমানে।

দেশের বিভিন্ন কংগ্রেস প্রতিষ্ঠানের নেতা ও কর্ম্মীদের নিজেদেরও কোন কার্য্যকরী শিক্ষা নাই এবং কোন বিশেষজ্ঞের সাহায্যও তাঁরা কখনও গ্রহণ করেন না। আমাদের চরকা-মার্কা অর্থনীতির পরিকল্পনা থেকে, গুরুকূল ও আশ্রম-মার্কা জাতীয় শিক্ষা, অসহযোগ মার্কা সহযোগিতা, ত্রেতা ও দ্বাপর যুগের হাতিয়ার নিয়ে শিল্পোদ্ধার সবই আমরা করি আনাড়ীর মত। ফলে প্রত্যেকটি সমস্যা যেমন সঙ্গীন ছিল তেমনিই থেকে যায়, কংগ্রেস করেন তাকে ঘিরে শুধু নর্ত্তন কুর্দ্দন, শুধু বক্তৃতা, শুধু প্রস্তাব পাশ; বড় জোর একটা লোক-দেখানো চমকপ্রদ demonstration; এ যাবৎ আমাদের কাজের ছকের সঙ্গে উপবাস, প্রার্থনা, হরতাল, করতালি, নিরামিষ আহার, খদ্দর পরিধান, পাইখানা পরিষ্কার ইত্যাদি নানা অপূর্ব্ব উপাদান জগা খিচুড়ি হয়ে মিশে এক অপূর্ব্ব পদার্থ সৃষ্টি করেছে। দেশের সঙ্গীন অর্থ সমস্যা, শিক্ষা সমস্যা, স্বাস্থ্য সমস্যা, সমাজ সমস্যা, এবং সত্যকার খাঁটি রাজনীতিক দীক্ষা সবই এই জগাখিচুড়ীর জটিলতায় ব্যর্থ ও নিস্ফলা হয়ে আছে।

অতিমাত্রায় রাজনীতিকতাও আমাদের বিস্মৃত করিয়ে দিয়েছে, যে, জীবনটা শুধু রাজনীতি নয়। যে ভারতে শতকরা নব্বই জন কান যুগেই উদর পূর্ত্তি করে দুবেলা আহার পায় নাই, সে ভারতে নিছক রাজনীতিক স্বরাজে এ জাতীর দৈন্যের কোনও কিনারাই হবে না। সে রকম রাজনীতিক স্বরাজ মুষ্টিমেয় ভদ্রলোকের করবে গতি, যাদের পেশা রাজনীতিক আন্দোলন তাঁদের মেলাবে মোটা মোটা চাকুরী ও পদমর্য্যাদা। চাকুরী-লোভীদের চিৎকারই এই জাতীয় স্বরাজ আন্দোলনের বার আনা। জাতির জীবনের মানযন্ত্রে যারা চিরদিন life-line বা জীবন-রেখার নীচে মৃত্যুরেখার কাছাকাছি পড়ে আছে তাদের বাঁচবার উপায় কোন দেশেই নিছক রাজনীতিক স্বরাজের দ্বারা হয় নাই, হয়েছে গঠনের কাজে, বিশেষ আন্দোলন ও বিধি বা legislation এর চাপে। দেশের যারা মধ্যবিত্ত তাদেরও জীবন দৈন্যরেখা ঘেঁসে চলে, তারা রোজ আনে রোজ খায়, আধিব্যাধি অপঘাত ও মৃত্যুর জন্য কোন উদ্বৃত্তই তাদের জমার খাতে পড়ে না। তাই রামচন্দ্র যখন রাজা হন তখন বানরের ভাগ্যেই পড়ে দু’ একটা কদলী মাত্র, সুগ্রীব হনুমান জাম্বুবানই আপোসে রাজ-প্রসাদ করে নেয় ভাগবাঁটোয়ারা।

চাষী পড়ে থাকে তার দৈন্য ও ঋণের আঁস্তাকুড়ে; শ্রমজীবিরা অবহেলার বস্তিতে বস্তিতে গড়ে চলে তাদের ভাঙা চোরা বিশৃঙ্খল ইউনিয়ন; ম্যালেরিয়া কচুরীপানা দুর্ভিক্ষ মহামারী বেড়ে চলে চক্রবৃদ্ধির হারে ছারপোকার বংশের অনুপাতে। তার সঙ্গে মহা জাঁকজমকে চলে কংগ্রেসের নেতাদের ধ্বজপতাকাময় জয়যাত্রার সাজানো রথ—চরকা ও দুর্মূল্য খদ্দরের তালে তালে। সমস্যাগুলির সমাধান যতটুকু হয় তা করবার জন্য আছে কেবল ঐ দেশবর্জ্জিত সয়তানী বিদেশী গভর্ণমেণ্ট। আমরা তার কৃষি-ঋণ বিল, তার কচুরীপানা ধ্বংস বিল, তার পূর্ত্ত বিভাগ, তার শিল্প গঠন প্রচেষ্টা, তার বেকার সমস্যা সমাধানকে মনের আনন্দে গালি পাড়ি কিন্তু তাকে কার্য্যকরী করবার জন্য সাহায্য মাত্র করি না, কারণ পাছে সেগুলি কার্য্যকরী হলে গভর্ণমেণ্টের প্রেষ্টিজ যায় বেড়ে কংগ্রেসের প্রেষ্টিজ যায় কমে।

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের প্রাণ সত্য সত্যই দেশের জন্য কেঁদেছিল, মহাত্মাজীও জীবনপণ করেছেন দলিতোদ্ধারে, কুটীর শিল্পোন্নতিতে, জাতির আত্মশুদ্ধির মহাযজ্ঞে, কিন্তু তাঁদের সহুরে ইংরাজিনবীশ কর্ম্মীদের আর দরিদ্র দেশবাসীর মাঝে আছে এক বিরাট ব্যবধান। সে ব্যবধান বা প্রাচীর হচ্ছে এক দিকে অজ্ঞান ও অন্য দিকে কৃত্রিম অকেজো পুঁথিগত বিদ্যার প্রাচীর। দেশবন্ধুর প্রেমিক কবিপ্রাণের উন্মাদনা ও বাণী হাজারে হাজারে আনাড়ী ছাত্রকে পাঠিয়েছিল পল্লীর অস্বাস্থ্যকর দৈন্যে ও অন্ধকারে, লক্ষ লক্ষ টাকা জলে দিয়ে তারা ফিরে এসেছিল ভগ্ন মন ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে। আমরা বনের অজ্ঞ বানরের মত গিয়েছিলাম জীবনের জটিল বিপুল যন্ত্র মেরামত করতে। এই হচ্ছে আমাদের কংগ্রেসী গঠন, স্বরাজের ভিত রচনা। কারণ এখনও আমরা ভাবি দেশ থেকে ইংরাজ তাড়ানো সহজ ও প্রথম কাজ, কিন্তু দেশের দৈন্য ও অশিক্ষা নিবারণ বড় কঠিন ব্যাপার; ও-সব স্বরাজের পরে পশ্চাতে দেখে নেওয়া যাবে। আমাদের দেশের কাজে ষ্টীম্‌ জোগাতে পারে এক প্রবল বিদেশী বৈরী, এ রাজনীতিক শত্রু যদি কখনও মিত্রে পরিণত হয় তা’ হলে আমাদের বিদ্বেষমূলক জাতীয়তা বেলুনের মত ফেঁসে যাবে, এই ভয়ে এ শত্রুকে আমরা দেশকল্যাণের সহযোগী করতে আদৌ প্রস্তুত নই। অসহযোগের মনটাকে কাজেই নানা উপায়ে চাবুক মেরে মেরে জাগিয়ে রাখা আমাদের কর্ম্ম-বিমূখ আন্দোলন-লোভী রাজনীতির অবশ্য কর্ত্তব্য।

গণশক্তির কল্যাণে কংগ্রেস কার্য্যতঃ সর্ব্বদাই বিমুখ, আজ মাত্র দু’ চার বছর তার চিন্তা জেগেছে দেশের নিরন্ন বঞ্চিত চাষী মজুরের কল্যাণের দিকে; কিন্তু জাতীয় মহাসভার কাজে তাদের সহযোগিতার কোন ব্যবস্থা তো করাই হয় নাই, তাদের অভাব অভিযোগ নিবারণ করাটা কংগ্রেসের কর্ম্মধারার মাঝে নিতান্তই গৌণ হয়ে আছে। নেতারা যে বলেন, যে, স্বরাজ তাদের কল্যাণ করবে এর চেয়ে বড় মিথ্যা কথা আর নাই। রামচন্দ্রের যুগ থেকে আজ পর্য্যন্ত কোন স্বাধীন দেশেই স্বরাজ তাদের দৈন্য ঘুচায় নাই, তাদের মানুষ করবার চিন্তা পর্য্যন্ত সেখানে নাই। ভদ্রলোকের রচিত সমাজ ও রাষ্ট্র মুখ্যতঃ শুধু তাদেরই কল্যাণ করেছে এবং ধর্ম্মের ও বর্ণ গরিমার নামে জনসাধারণের পায়ে শিকলের উপর শিকল পরিয়েছে। গণশক্তির জাগরণ, তাদের মনুষ্যত্বে দীক্ষা দান, সমাজে তাদের সমান অধিকারের ব্যবস্থা করা এ সব স্বপ্ন পাশ্চাত্যেই জেগেছে। যাদের আমরা ভারতের স্বাধীনতার অপহর্ত্তা ম্লেচ্ছ জাতি বলে ঘৃণা করি তারাই জগতের শূদ্রকে মানুষ বলে বুকে নেবার স্বপ্ন সেই ফরাসী বিপ্লবের দিন থেকে আজ অবধি দেখে আসছে, এরাই হচ্ছে সত্যকার মুক্তির পূজারী, আমরা দাসত্বের রচয়িতা ও মানুষের বন্ধনের ঋষি মাত্র।

মুক্তি কোন্ পথে?—

ভাঙনের ও নেতি নেতির আবহাওয়ায় গড়া আমাদের রাজনীতিক মন দেশব্যাপী গঠনের বৃহৎ পরিকল্পনা করতে পারে না, জাতীয় জীবনের মহাব্রত উদ্‌যাপনে উদ্দীপনা যোগাতে পারে তেমন কার্য্যকরী ব্যাপক চেষ্টা ধারণা করা এই ফাঁকা আন্দোলনবিলাসী জাতির পক্ষে কঠিন। দেশের তরুণ ছেলে মেয়েরা হাজারে হাজারে লাখে লাখে নেমে গেছে ঔ অস্পৃশ্য আপাঙক্তেরের স্তরে, ঐ মাঠের কাদায়, কারখানার ধুলায় ও ধোঁয়ায়, হাটের বিকিকিনির গণ্ড গোলে; সেখানে তাদের মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তির বলে তারা প্রাণপাত করে গড়ে তুলছে তিলে তিলে সুখসমৃদ্ধির ও ধন ধান্যের ভারত—এ স্বপ্ন আমাদের নেতাদের রাজনীতি-বিকৃত মস্তিষ্কে গজানো শক্ত কথা। রাজনীতিক চালের সহজ চালিয়াৎ আমরা এখনও বুঝি নাই, যে, খাঁটি গঠনের মাঝেই আছে সত্যকার ভাঙনের বীজ। নূতন জীবন-ধারাই পুরাতনের জাঙ্গালকে নিতে পারে ভাসিয়ে। গঠনের পরিকল্পনা ও চেষ্টা বর্জ্জিত নিছক ভাঙার জন্য যে উন্মাদনা সে হচ্ছে অবোধ বালক বা পাগলের কাজ।

দেশ যখন ভ্রান্ত ধারণার বশে একটা প্রাণহীন পুরাতনকে বা গলিত শবকে আঁকড়ে পড়ে আছে, তখন তাকে একটি নূতন রূপে ও সুষমায় এবং নূতন প্রাণধারায় জীবন্ত ও সুন্দর কিছু দেখালেই পার্থক্যটা তার চোখে যেমন সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে কথায় তা’ কখনও হবে না। পুরাতন মৃত বনাকীর্ণ পল্লীর পাশে গড়ে তোল একটি শ্রীসম্পন্ন পরিচ্ছন্ন নূতন পল্লী,—সমবায় পদ্ধতিতে যার আছে বৃহৎ যৌথ কৃষি ক্ষেত্র, যৌথ কৃষি ব্যাঙ্ক, নিজস্ব ম্যার্কেটিং বোর্ড, যৌথ যান বাহনের ব্যবস্থা, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগার, বৈজ্ঞানিক কৃষিযন্ত্রাদি, চিনি লবণ ও শিল্পের কারখানা, তা’ হ’লে অজ্ঞ চাষীর মনে আপনি জাগবে নূতন আশা, নূতন স্বপ্ন। এইরূপ একটি নূতন পল্লীই দেশে আপনি গজিয়ে তুলবে পল্লী-লক্ষ্মীর এরকম শত শত জীবন্ত পীঠস্থান। তখন কাজের ইন্দ্রজাল স্পর্শে দেশজুড়ে নিমেষে জাগবে সত্যকার কাজ, দশ বছরের কথায় যা’ জাগতে পারে নাই। মন ও স্বাস্থ্য যাদের গেছে ভেঙ্গে, অভাব ও ঋণভার যাদের মন ও প্রাণ করেছে সঙ্কীর্ণ, ক্ষুদ্র ও বক্তিগত স্বার্থের লোভী, তাদের চোখের উপর ভবিষ্যৎকে হাতে কলমে গড়ে না তুললে তারা শিক্ষিত সম্প্রদায়কে কখন বিশ্বাস করবে না।

যে ভদ্রলোকেরা জমিদার রূপে, মহাজন রূপে, সরকারী কর্ম্মচারী রূপে, ডাক্তার উকিল রূপে করেছিল এত দিন তাদের শোষণ ও শাসন, তাদের কথার তখনই হবে মূল্য, দেশের চাষীর কাছে, মজুরের কাছে, নিঃস্বের কাছে; তখনই তারা শুনবে আমাদের স্বাস্থ্যের বক্তৃতা, মদ্য নিবারণী কচায়ন, ভোটের মূল্যের কাঁদুনী। গ্রামের মাঝখানে শিল্পের ছোট ছোট কারখানা— যেখানে অবসর সময়ে, অজন্মার সময়ে তাদের ছেলে মেয়ে কাজ পায়, উপরি উপার্জ্জন করতে পারে,—সেইগুলিই নিতে পারে সত্যকার স্কুলের জায়গা, প্রকৃত শিক্ষাকেন্দ্রের স্থান। দরিদ্র নিরন্নকে অতিথ শালা ধর্ম্মশালা খুলে জলাশয় খনন করে ভিক্ষা দেবার ও উপকার করবার পুরাতন প্রথা দিতে হবে তুলে। দানের অপমানে তাদের অন্তরের দরিদ্র নারায়ণ কখনও মানুষ হবে না; তাকে শেখাতে হবে মানুষ হতে, নিজের অদৃষ্ট নিজে ফিরাতে; তাকে ফিরে দিতে হবে সামর্থ্য ও সাহস—নিজে উঠে দাঁড়াবার, বড় হবার।

আমাদের কুটীর শিল্পোন্নতি ও বৈজ্ঞানিক কৃষির পরিকল্পনার মাঝে অঙ্গীভূত করে নিতে হবে দেশের বাধ্যতামূলক শিক্ষাকে, পল্লী স্বাস্থ্যের অভিযানকে। যারা উপায় করবে অন্ন বস্ত্রের তারাই দেবে জ্ঞান। সহস্র সহস্র পল্লীতে চাই অবৈতনিক শিক্ষাকেন্দ্র; সমবায় পদ্ধতিতে শিল্প ও যৌথকৃষির সেই স্বাবলম্বী কর্ম্মীদল—তারাই অবসর সময়ে হবে গ্রামের স্কুল। এই গঠন শিল্পীর দল নিজেদের ও পল্লীর অন্ন বস্ত্রের সংস্থান করে নিজেরাই হবে অবৈতনিক শিক্ষার বাহন। এই ফ্যাক্টরী-স্কুল ও ফার্ম-স্কুল গুলিই একই সমবায় প্রণালীর অন্তর্গত হয়ে সহজেই পূরণ করতে পারে কৃষকের সকল উন্নতির প্রচেষ্টার স্থান।

দেশের ত্যাগী মহাপ্রাণ তরুণদের নিয়ে ভূয়া আন্দোলনের ভ্যাগাবণ্ড্ ভলাণ্টিয়ার গড়ে কোন লাভ নাই। দেশ-গঠনের এত সুন্দর উপকরণ এমন করে বিকৃত ও অপব্যয় করার মত পাপ আর কি আছে? যে নিজের পায়ে স্বাবলম্বী হয়ে দাঁড়িয়েছে সেই পারে অন্যকে স্বাবলম্বী হবার শিক্ষা দিতে, গ্রামের অনুকম্পার ভিখারী ও ফাঁকা কথার ব্যবসায়ী তা পারে না। যে রাশি রাশি টাকা ও প্রাণশক্তি আমরা অচল খদ্দরের পায়ে ঢেলেছি তার অর্দ্ধেকে গড়ে উঠতে পারে হাজার পল্লী জুড়ে এমনি একটি স্বাবলম্বী পল্লী-বিশ্ববিদ্যালয়। যাঁরা হাতের কাজে আনাড়ী, বৃহৎ গঠনমূলক প্রতিষ্ঠানে অনভ্যস্ত, তাঁরা এ কাজে হাত না দেওয়াই ভাল। দেশ জুড়ে খাঁটি কর্ম্মচক্র গড়তে হলে চাই বিশেষজ্ঞের সাহায্য, গভীর চিন্তা, হাতে কলমে বহু পরীক্ষা, এই দিক দিয়ে বহু তথ্যসংগ্রহ, দেশজুড়ে পর্য্যটন ও বহুমুখী অভিজ্ঞতা। দেশবাসী ও গভর্ণমেণ্টের সমবেত শক্তিই কেবল এ দুরূহ ব্রত উদ্‌যাপন করতে পারে।

শ্রীঅরবিন্দের জাতীয় শিক্ষা, দেশবন্ধুর পল্লীসংগঠন, মহাত্মাজীর অর্থনীতিক প্রচেষ্টা ও অস্পৃশ্যতা নিবারণ সবই সমান বর্থতায় পর্য্যবসিত হয়েছে, কারণ এঁরা সকলেই উপেক্ষা করেছিলেন দেশের শাসন শক্তিকে, ব্যবস্থাপক মণ্ডলীকে, legislative ও executive শক্তিকে। তাঁরা গেছিলেন হাওয়ায় রাজপ্রাসাদ গড়তে, ভাবের চোরাবালুর উপর দেশযজ্ঞের ভিত্তি রচনা করতে। তাই স্বায়ত্তশাসনে নাগরীক স্বাধীনতা দিতে হয়েছিল ঐ বহু-লাঞ্ছিত Satanic গভর্ণমেণ্টের সাহায্যে নরম-পন্থীর রাজা সুরেন্দ্র নাথকেই। বাংলায় দেশবন্ধুর স্বরাজ্যদলের যত শক্তি যত চেষ্টা ও স্থায়িত্ব সবই মডারেটের দান সেই কর্পোরেশনেরই প্রসাদাৎ।

এই কর্ম্মনাশা মনোবৃত্তির চাই আশু অবসান; নেতায় ও শাসকে আসা দরকার সহযোগিতা। তা’ নইলে দেশব্যাপী গঠন আকাশ-কুসুম হয়েই থাকবে। দেশের শাসন-শক্তি যে নিতান্তই দেশের, জাতীয় ধনজনবলেই তা গঠিত ও পুষ্ট,—তা’ হাজার বিদেশীর সাহায্যই সেখানে থাকুক, এই মোটা কথাটা দেশের কর্ম্মী ও নেতাদের বুঝবার দিন এসেছে। যারা তা’ বুঝতে চায় না তারা চায় না দেশে খাঁটি কাজ; তারা চায় ভূয়া প্রেষ্টিজ, রাজনীতিক অহমিকায় তাদের চক্ষু করেছে প্রকৃত দেশকল্যাণের দিকে অন্ধ। বিদেশীরা অমানুষ আর আমরাই মানুষ, এ বৃথা গর্ব্ব আঁকড়ে আমরা বহুদিন কাটিয়েছি! তার ফলে দেশ চলেছে অধোগতির পথে। আমাদের এই মলিন অহমিকা, দ্বেষ ও ঘৃণা বুদ্ধি বিদেশী শাসকের মাঝে যদি জাগিয়ে তোলে ক্রোধ ও দলন-প্রবৃত্তি সেটা কি খুবই অস্বাভাবিক?

বারীন্দ্রকুমার ঘোষ
ভারত কোন্‌ পথে?
১৯৩৬


Leave a Reply