প্রকৃতির ছায়ায় মানুষের অন্ত:স্বর
বস্তুত সাহিত্যের প্রতিটি ধারাই একেকটা নদী—কখনো উচ্ছল, কখনো গভীর নীরব, আবার কখনো প্রকৃতির বুকে ঝর্ণার মতো জেগে ওঠে। এধরনেরই এক নবজন্ম প্রাপ্ত ধারা হলো ইকো-ফিকশন (Eco-fiction)। এই ধারায় মানুষ আর প্রকৃতি আলাদা থাকে না, আলাদা ভাবা যায় না—দুইয়ে মিলে গড়ে ওঠে এক আদি সম্পর্ক, এক অনন্ত সংলাপ। মানবজীবন আর পরিবেশের আলিঙ্গন থেকেই জন্ম নেয় এই সাহিত্যের আঙ্গিক।
জন্মবিন্দু থেকেই মানুষ প্রকৃতির সন্তান। প্রকৃষ্ট কৃতির চলমান উপপাদ্য, বিশাল ক্যানভাসের উপর ঈশ-কৃষ্টি । পৃথিবীর সৃষ্টি, জৈব উপাদানের উদ্ভব, এই সবই এক অখণ্ড পরম্পরার অংশ—এখানে মানবসত্তা নিছকভাবে বিচ্ছিন্ন নয়, সে নিজেই এক প্রাণীজ পরিসরের প্রতিফলন। মানুষ তার চারপাশের গন্ধ, রং, শব্দ, আকাশের রোদ, নদীর বয়ে যাওয়া, বৃক্ষের ছায়া—এই সমস্ত উপাদানেই গঠিত হয়। তার অনুভব, তার চেতনা, তার ভাষা—সবই প্রাকৃতিক কাঠামোর মধ্যে নিজেকে (ego) খুঁজে পায়।
ঋগ্বেদের ঋষিরা তো জানতেন—আত্মাকে খুঁজতে হলে প্রকৃতিকে জানতে হয়। তাঁরা চোখ মেলেছিলেন বহির্বিশ্বে, তাকিয়েছিলেন গাছের পাতায়, পাহাড়ের গায়ে, নদীর ধারা আর আগুনের শিখায়। তাঁদের কল্পনায় প্রকৃতি হয়ে উঠেছিল প্রাণবান, সজীব, স্পন্দিত। সেই সজীব প্রকৃতি থেকেই তাঁরা আহরণ করেছিলেন ‘ব্রহ্ম’—এক সর্বব্যাপী সত্তা, যার বিচিত্র রূপে উদ্ভাসিত হয়েছে অগ্নি, বায়ু, ইন্দ্র, বরুণ, মিত্র, বিষ্ণু, রুদ্র প্রভৃতি দেবতা। এই ৩৩ দেবতা শুধুই কোনো দেবলোকের অধিবাসী ছিলেন না, ছিলেন এই ভূলোকের, এই মাটিরই অংশ। তাঁরা বুঝেছিলেন, এই সৃষ্টির উপাদানসমূহ মানবজীবনের সঙ্গে জড়িয়ে, আলাদা নয়। ওতপ্রোত মাত্র ।
আধুনিক ইকো-ফিকশন এই ধারণাকেই শিল্পিত করে তোলে। মানুষের অস্তিত্বকে শুধু অর্থনৈতিক, সামাজিক বা মানসিক স্তরেই নয়—জৈব, পরিবেশিক, প্রাণিক স্তরেও বিচার করে। গাছের সঙ্গে আলিঙ্গনে, নদীর ধারে বসে ধ্যানস্থ হওয়ায়, পাহাড়ের পাথরে হাত রেখে অনুভব করায়—মানুষ যেন নিজের অস্তিত্ব ফিরে পায়, নিজের শিকড় স্পর্শ করে। এক বৃক্ষকে নিজের সন্তানরূপে লালন করায় যে অনাবিল আনন্দ, তা তো এক নতুন জন্ম, এক নবজীবন।
হয়তো গির্জায় গিয়ে প্রার্থনা করাও শ্রেয়, কিন্তু তার চেয়েও বেশি জীবন্ত অভিজ্ঞতা হতে পারে এক রবিবার সকালে বনভূমির কাছে গিয়ে কোনো প্রাচীন বৃক্ষের পাদদেশে বসা, তার শিকড়ে জলের কলসি রেখে নিবেদন করা—তখন প্রকৃতি এক মহাজীবন্ত আত্মা হয়ে এসে মন-মানসকে পরিপূর্ণ করে। জঙ্গলের আত্মা বুকের ভিতরে তখন মঙ্গল কথা বলে। বনদেবীর মঙ্গলা কাব্য ।
যে গল্পে নদী নিজেই হয়ে ওঠে কন্যা—যেমন ভগীরথের আহবানে প্রাচীন গঙ্গা, বা যজ্ঞের অৰ্হম শব্দে উঠে আসা জহ্নুর কন্যা জাহ্নবী—সে গল্প শুধু পৌরাণিক কল্পনা নয়, বরং এক প্রগাঢ় ইকো-কাব্য, ঋষির আরণ্যক। যেখানে সরস্বতীর তীরে ধ্যানভূমি উপনীত ঋষির চেতনাচৈত্যে নদী রূপ পায় মানবতায়, শ্বেত বস্ত্র পরিহীতা এক কন্যা হয়ে উঠে আসে এবং বলে, “তুমি আমার পিতা, আমি তব জলধারা!”—সেই মুহূর্তেই সাহিত্য হয়ে ওঠে প্রকৃতির আত্মার সঙ্গম।
এইভাবে ঋগ্বেদের ঋষিরা গাইতেন জলগাথা, অন্তত ৬০০০ বছর আগে। সেই গাথা আজ ইকো-ফিকশনের মাধ্যমে ফিরে আসে, নতুন ভাষায়, নতুন কল্পনায়। আজকের মানুষ যখন কেবল ভোগের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রকৃতির দিকে তাকায়—চায় কেবল পাওয়া, কেবল দখল—তখন সাহিত্যের এই ইকো-পথ তাকে শোনায় এক নতুন বার্তা। চাহিদা আর জোগানের দ্বৈততা ছাড়িয়ে, সম্পর্কের বন্ধনে প্রবেশ করার আহ্বান।
এই সম্পর্ক, এই আত্মিক সংলাপ, এই গাছের ছায়ায় বসে জীবনের পাঠ শোনার অভিজ্ঞতা—সেই তো সত্যিকারের সাহিত্য, সত্যিকারের জীবন, সাথে চলার চালচিত্র। সাহিত্য তখন আর কল্পনা নয়, তখন সে জীবন নিজেই—জীবন যে প্রকৃতির স্রোতে ভেসে চলে, বনানীর ছায়ায় জলছবি আঁকে।
সাহিত্য সম্রাট: 23rd May 2025