অত্যাচারী সিরাজউদ্দৌলার পতন

অত্যাচারী সিরাজউদ্দৌলার পতন

বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের বিশ্বকোষ (Encyclopedia of Bengali Language and Literature)

তন্ময় ভট্টাচার্য (অ্যাডভোকেট)

বাংলার ইতিহাসের এক অশান্ত অধ্যায় নবাব মির্জা মুহাম্মদ সিরাজউদ্দৌলার (Shuja-ud-Daula) জীবনকথা। ১৭৩৩ সালে তাঁর জন্ম এবং ১৭৫৭ সালের ২ জুলাই মাত্র ২৪ বছর বয়সে তাঁর মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। তিনি ছিলেন আলিবর্দী খাঁর নাতি ও উত্তরসূরি। ১৭৪৬ সালে যখন আলিবর্দী খান মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রওনা দিলেন, তখন তরুণ সিরাজকে পাটনার শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু শাসনকালে সিরাজ নানা আর্থিক অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। বিশেষ করে জৈন-বাঙালি অর্থলগ্নিকারী ও মানি-চেঞ্জারদের কাছ থেকে তিনি বেআইনিভাবে অর্থ আদায় করতেন। এতে আলিবর্দী অসন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে পাটনা থেকে সরিয়ে ঢাকার নৌসেনার দায়িত্ব দেন।

১৭১৭ সালে বাংলার রাজধানী মুঙ্গের থেকে মুর্শিদাবাদে (গৌড়)স্থানান্তরিত হয়। মুর্শিদাবাদে জৈন সম্প্রদায়ের যথেষ্ট প্রভাব ছিল, তারা অর্থব্যবসা ও মানি-চেঞ্জিং নিয়ন্ত্রণ করত। মুঙ্গের, রাজমহল এবং পাটনা অঞ্চলে তখন বিপুল সংখ্যক বাঙালি বাস করত। তখন বাঙালিরা ছিল খাঁটি যোদ্ধা এবং ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। এই অঞ্চলটি তখন শশাঙ্কগৌড়ের প্রাণকেন্দ্র ছিল।

আলিবর্দী খাঁ ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করলে বাংলায় অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এই সুযোগে শাহ কুলি খান মির্জা মুহাম্মদ সিরাজ মুর্শিদাবাদ দখল করে বাংলার, বিহারের ও উড়িষ্যার নবাব হিসেবে নিজেকে ঘোষিত করেন। ঘসেটি বেগম (মেহেরুন্নেসা বেগম), আলিবর্দীর জ্যেষ্ঠ কন্যা ছিলেন সিরাজের প্রবল বিরোধী। ঘসেটির ঘনিষ্ঠ ছিলেন ঢাকা নবাবখানার তহবিলদার রাজবল্লভ। তিনি নিজের পুত্র কৃষ্ণবল্লভকে বিশাল অর্থ দিয়ে কলকাতায় পাঠান অস্ত্র কেনার জন্য। কৃষ্ণবল্লভ খিদিরপুরে অবস্থান করে কোম্পানির ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করতেন এবং তা ঘসেটি বেগমকে পাঠাতেন। বর্ধমান রাজ্যের শক্তিগড়ে সামরিক ছাউনি ছিল, সেখান থেকেও সামরিক সরঞ্জাম সংগৃহীত হতো। এগুলি দূর্গ-মকুয়ার থানায় (হাওড়া) জমা রেখে গঙ্গাপথে গোরাবাজারে পাঠানো হতো।

১৭৫৬ সালের ১৮ জুন সিরাজ কলকাতা আক্রমণ করেন এবং ২০ জুন কলকাতা বজ-বজের দুর্গ দখল করেন। দুর্গে প্রবেশ করে দরবারে বসে তিনি উমিচাঁদ ও কৃষ্ণবল্লভকে উপস্থিতির আদেশ দেন। তারপর মানিকচাঁদকে দুর্গের দায়িত্ব দিয়ে রাজধানীতে ফিরে আসেন। কিন্তু শিগগিরই রবার্ট ক্লাইভ মাদ্রাজ থেকে এসে দুর্গ পুনর্দখল করেন। ১৭৫৭ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি আলীপুর এলাকায় সিরাজের সঙ্গে ব্রিটিশদের সন্ধি হয়। সেই সময়ে সিরাজের প্রশাসনিক কার্যালয় বর্তমান আলীপুর সিভিল কোর্ট কমপ্লেক্স এলাকায় ছিল।

মেটিয়াবুরুজ অঞ্চলে নবাবের একটি ছোট দুর্গ বা কেল্লা ছিল, যার সঙ্গে যুক্ত ছিল তোপখানা বা কামানবিভাগ। এই স্থানটি কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ এখানে একটি কাস্টম শুল্ক আদায় কেন্দ্রও স্থাপন করা হয়েছিল। নদীপথে কলকাতা ও মুর্শিদাবাদের সঙ্গে বাণিজ্য ও যোগাযোগের জন্য এটি ছিল একটি প্রধান কেন্দ্র। গঙ্গার তীরবর্তী এই স্থানে আসা–যাওয়া করা বাণিজ্যিক নৌযান থেকে নবাবি প্রশাসন শুল্ক আদায় করত, আর সেই সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য ছিল ছোট দুর্গ ও কামানের অবস্থান। জাহাঙ্গীর মেটিয়াবুরুজের তোপপখানা ও ছোট কেল্লা নির্মাণ করেন — এই কৌঁসুল্যপূর্ণ স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছিল মূলত বঙ্গ উপকূলে বিচরণকারী পর্তুগিজ জলদস্যুদের প্রতিহত করার জন্য এবং গঙ্গা পথে পর্তুগিজ জাহাজদের বান্দেলমুখী (Bandel) চলাচল নিয়ন্ত্রণে রাখতে।

সিরাজের বাহিনীর প্রধান সেনাসরবরাহকারী ছিলেন মীর জাফর, যিনি পলাশীর সেনাছাউনির প্রধানও ছিলেন। সিরাজের বাহিনীর সেনা কমান্ডার ছিলেন রায়দুর্লভ, ইয়ার লতিফ খান, মীর মদন, মোহনলাল এবং ফরাসি সেনাপতি সাফ্রেঁ। কিন্তু সিরাজের দুর্বল নেতৃত্ব, অদক্ষ প্রশাসন ও আর্থিক সংকটে একে একে অনেকে তাঁর বিরুদ্ধে চলে যান। সিরাজ কখনও তার সেনাবাহিনী পরিদর্শন করেননি, বরং তিনি ব্যক্তিগত দেহরক্ষী এবং অ-সামরিক সশস্ত্র দলের সাথে চলাফেরা করতেন। স্থানীয় সিকদাররা তাঁর বাসস্থান এবং খাবারের ব্যবস্থা করতেন। তিনি পিস্তল রাখতেন কিন্তু যুদ্ধের উদ্দেশ্যে কখনও এটি অনুশীলন করেননি।

সিরাজ নিজে অশিক্ষিত ছিলেন, কিন্তু তিনি মুঘল আকবরের মতো ছিলেন না। আলিবর্দী তাঁকে বহুবার সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে বললেও তিনি অবহেলা করতেন। মীর মদন (‘মীর’ মানে সেনাপতি), যিনি হিন্দু থেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, ছিলেন এক দক্ষ যোদ্ধা ও তলোয়ারবাজ। তাঁকে দিয়ে আলিবর্দী সিরাজকে প্রশিক্ষণ দিতে চাইলেও সিরাজ অপমান করে তাঁকে সরিয়ে দেন। তবুও মীর মদন পলাশীর যুদ্ধে প্রাণপণ লড়েছিলেন।

সিরাজ ছিলেন মদ্যপ, ভোগ-বিলাসী ও অত্যাচারী প্রকৃতির। তিনি নদিয়া-শ্রীকৃষ্ণনগর অঞ্চলের হিন্দু মহিলাদের অপহরণের অভিযোগে কুখ্যাত হন। এতে কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র (১৭১০-১৭৮৩ খ্রি.) তাঁর প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এবং কলকাতায় ক্লাইভের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। সিরাজের প্রশাসনিক জ্ঞান ছিল প্রায় শূন্য। তিনি বাংলা ভাষা জানতেন না, হিন্দুস্তানি বলতেন এবং সামান্য ফারসি পড়তে পারতেন। দিল্লির মুঘল সম্রাটদের পাঠানো দলিল পড়তে স্ত্রীর সাহায্য নিতেন, কিন্তু কখনো জবাব দিতেন না।

তিনি সকাল ৯টায় ঘুম থেকে উঠতেন, দুপুর ১২টায় দরবার বসাতেন এবং দুপুর ২টায় উঠে যেতেন। সন্ধ্যার পর কারও সঙ্গে রাষ্ট্র বা সামরিক আলোচনায় বসতেন না। তখন ছিল তাঁর ভোগ-বিলাসের সময়। অর্থাভাব মেটাতে তিনি প্রায়ই আলিবর্দীর ঘনিষ্ঠ জগতসেঠ পরিবারের কাছ থেকে ঋণ নিতেন। একবার জগতসেঠ তাঁকে তিন কোটি টাকা ঋণ দিতে অস্বীকার করলে সিরাজ তাঁকে চড় মেরে বসেন। জগতসেঠ কলকাতায় মীর জাফর, কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র এবং রবার্ট ক্লাইভের সঙ্গে বৈঠক করেন। আলোচনায় তিনি প্রতিশ্রুতি দেন যে, যদি ক্লাইভ সিরাজের বিরুদ্ধে অভিযান চালান তবে তিনি বিপুল অর্থ সাহায্য করবেন। এমনকি কলকাতার দুর্গ মেরামতের জন্য অর্থ এবং ক্লাইভের ব্যক্তিগত স্বার্থে লন্ডনে একটি সম্পত্তি কেনার জন্য অর্থ দেওয়ার আশ্বাস দেন।

ঘোসেটি রাজবল্লভের কাছ থেকে এটি জানতে পেরেছিলেন। তিনি মীর জাফরের সাথে কথা বলেছিলেন এবং জগৎ শেঠের কাছে সাহায্যের জন্য একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন।

অন্যদিকে, তখন ইংল্যান্ডের দৃষ্টি শুধু ভারতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ১৭৫৬ সালে আমেরিকার ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে গোপন প্রতিবাদের পরিকল্পনা হচ্ছিল। তখন ব্রিটেনের সিংহাসনে ছিলেন দ্বিতীয় জর্জ। কয়েক দশক পর, ১৭৮৩ সালে, সেই উপনিবেশগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র—যুক্তরাষ্ট্র—হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

মীর জাফর ছিলেন শারীরিকভাবে শক্তিশালী ও দৃঢ়চেতা একজন সেনানায়ক। তিনি কঠোর সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন মীর মদনের তত্ত্বাবধানে। জীবনে কখনো মদ্যপান করেননি কিংবা হিন্দু নারীদের প্রতি অনৈতিক আচরণে লিপ্ত হননি। তাঁর মধ্যে ছিল রাজস্ব সংগ্রহের বিষয়ে স্পষ্ট জ্ঞান এবং ইংরেজদের গোলাবারুদের কারখানা সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য। ভাষাজ্ঞানে তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য—ফারসি ভাষার পাশাপাশি তিনি বাংলা লিখতে ও বলতে পারতেন। ইংরেজি ভাষাও শিখেছিলেন এবং লিখতেও সক্ষম ছিলেন। ধর্মীয় দিক থেকেও তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ব্যতিক্রমী। তিনি হিন্দু মন্দিরে মাথা নত করতেন ও ভেট দিতেন এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। মালদা ও বহরমপুর অঞ্চলে বৈষ্ণব সম্প্রদায়কে বসতি স্থাপনের অনুমতি দেন। আর্থিকভাবে জগতসেঠ পরিবারের সঙ্গে তাঁর গভীর সম্পর্ক ছিল, এবং তাঁদের মাধ্যমে দিল্লির সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে ওঠে।

পালাশির ছাউনি থেকে তিনি একটানা ঘোড়ায় চড়ে বর্ধমান পর্যন্ত পৌঁছাতেন। পথে বিশ্রামের জন্য তিনি যে স্থানে থামতেন, সেটি পরিচিত ছিল “ঘোড়দৌড় চটি” নামে, যা আজকের বর্ধমান পুলিশ লাইনের কাছে অবস্থিত। সেখান থেকে তিনি কাঞ্চননগরে যেতেন বর্ধমান রাজাকে সাক্ষাৎ করতে। তাঁর অধীনে ছিল শক্তিগড় ও পানাগড়ের সেনা ছাউনি (ছাউনি বা চৌনি), যা কৌশলগত দিক থেকে বর্ধমান রাজ্যের প্রতিরক্ষা ও সামরিক সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। জগতসেঠ ও দিল্লির সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক ছিল। মীর জাফর পিচকুড়ির ঢালে গোলাবারুদের কারখানা নির্মাণ করে বর্ধমান রাজাকে দেন।

সিরাজের ঋণ, অনভিজ্ঞতা ও দমননীতি তাঁকে ক্রমে একঘরে করে তোলে। স্থানীয় জমিদার, মুঘল মানসবদার এবং বণিক শ্রেণির অসন্তোষে তিনি দুর্বল হয়ে পড়েন। তিনি এক বছরের মধ্যেই মুর্শিদ কুলি এবং আলীবর্দীর তৈরি প্রশাসনিক কাঠামো ধ্বংস করে দিয়েছিলেন।

সিরাজউদ্দৌলার হিংস্র ও অস্থির শাসনব্যবস্থার কারণে মীর জাফর (১৬৯১ – ১৭৬৫) কখনোই তাঁর পক্ষে দাঁড়াননি। একটি বিষয় মনে রাখা জরুরি যে মীর জাফর সিরাজের দাস বা অনুগত সেনানায়ক ছিলেন না, যেমন ছিলেন মীর মদন। বরং মীর জাফর নিজে স্বাধীনভাবে নিজের ভাড়াটে সৈন্যদের খরচ বহন করতেন। সিরাজকে নিয়ম অনুযায়ী তাঁর বাহিনী ব্যবহারের জন্য অর্থ প্রদান করতে হতো, কিন্তু তিনি তিনবার সেই অর্থ প্রদানে ব্যর্থ হন।

সিরাজ ছিলেন একেবারেই দেউলিয়া নবাব। তাঁর নিজামত চলছিল বিপুল ঋণের ওপর—জগতসেঠ পরিবার, বর্ধমানের রাজা এবং মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কাছ থেকে তিনি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। ঢাকার দেওয়ানির ওপর তাঁর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ঢাকায় যে রাজস্ব সংগৃহীত হতো, তার কোনো সঠিক হিসাব রাখা হতো না। দিল্লির মুঘল দরবারে তিনি রাজস্ব দিতেন বিহার ও উড়িষ্যা থেকে আদায়কৃত অর্থ দিয়ে। এদিকে বাংলার স্থানীয় জমিদাররা একে একে তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে। মুঘল মানসবদাররাও তাঁর অব্যবস্থাপনায় ক্রুদ্ধ হন।

এমন পরিস্থিতিতেই ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর সংক্ষিপ্ত যুদ্ধে সিরাজ ব্রিটিশদের কাছে পরাজিত হন। ভোর থেকেই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, সকাল আটটায় যুদ্ধ শুরু হয় এবং সন্ধ্যা ছয়টার দিকে তা শেষ হয়। সেদিন প্রবল বৃষ্টি চলছিল, মাটিতে কাদা জমে গিয়েছিল। ইংরেজ সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভ নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেন, কিন্তু সিরাজউদ্দৌলা নিজ শিবির থেকে একবারও বাইরে বের হননি। তিনি নিজের শিবিরেই বসে মাঝে মাঝে নির্দেশ জারি করছিলেন। আশ্চর্যের বিষয়, যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর স্ত্রী লুৎফুন্নেসাও তাঁর সঙ্গে ছিলেন।

সিরাজ মীরজাফরকে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দিলেও মীরজাফর কোনো পদক্ষেপ নেননি। তিনি তাঁর বকেয়া পাওনা দাবি করলেন না, আবার যুদ্ধক্ষেত্রেও নামলেন না। তাঁর ৩০,০০০ সৈন্যদল দূরে দাঁড়িয়ে নিরব দর্শকের মতো অবস্থান করল। যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁরা সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় থেকে গেলেন। মীর মদন ছিলেন প্রবীণ যোদ্ধা, বয়সকালে এসেও তিনি প্রাণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ঘসেটি বেগমের লোকেরা সিরাজের রসদ সরবরাহের পথ কেটে দিলে সেনাদল দুর্বল হয়ে পড়ে। সিরাজ ভেবেছিলেন, কলকাতার যুদ্ধে যেমন মীরজাফর তাঁর পক্ষে লড়েছিলেন, এবারও তেমনি লড়বেন। কিন্তু তা আর ঘটেনি।

সিরাজ নিজে কোনো লড়াইয়ে অংশ নেননি। তিনি ইংরেজদের ওপর একবারও আক্রমণ চালাননি, কোনো কামান ছোঁড়েননি। কোনো ইংরেজ সৈন্যকেও তিনি নিজ হাতে হত্যা করেননি। তাঁর প্রিয় অশ্ব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, তিনি অশ্ব শুশ্রূষার কাজ জানতেন না, ফলে তিনি অশ্বারোহণও করেননি।

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন সন্ধ্যায় পলাশীর যুদ্ধে সিরাজ রবার্ট ক্লাইভের (১৭২৫ – ১৭৭৪) কাছে পরাজিত হন। তিনি স্ত্রী লুৎফুন্নেসা সহ ছদ্মবেশে পালিয়ে মুর্শিদাবাদে ফিরে আসেন এবং একা পাটনার দিকে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু ৪ জুলাই মীরজাফরের পুত্র মীরনের হাতে নিহত হন। মুর্শিদাবাদে ব্যাপক লুঠপাট হয় । এক রামচরণ রায়ের নাম ইতিহাসে উঠে আসে। তিনি ছিলেন রবার্ট ক্লাইভের একজন দফতরিক কর্মচারী বা ক্লার্ক। সুযোগ বুঝে তিনি আলিবর্দী খাঁর প্রাসাদ থেকে সোনা, রূপা, অলংকার ও গৃহপাত্রভর্তি তিনটি নৌকা লুট করেন। স্বরস্বতী নদী ধরে তিনি লুটের সম্পদ নিয়ে হাওড়ার আন্দুলে পৌঁছান। সেখানেই তিনি জমিদারি গড়ে তোলেন। তাঁর উত্তরসূরি রাজনারায়ণ পরবর্তীকালে সেই জমিদারির ওপর এক প্রাসাদ নির্মাণ করেন, যা আজও আন্দুল রাজবাড়ি নামে পরিচিত।

এদিকে সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর তাঁর স্ত্রী লুৎফুন্নেসার ভাগ্যও অন্ধকারময় হয়। ঘসেটি বেগম কূটকৌশলে তাঁকে প্রভাবিত করেন এবং নবাবি ভাণ্ডারের একাংশ নিয়ে গোপনে ঢাকায় চলে আসেন। কিন্তু সেখানে মীরজাফরের পুত্র মীরন তাঁদের আক্রমণ করে, নবাবি ভাণ্ডার পুনরুদ্ধার করা হয়, ঘসেটির দেহ পদ্মা নদীতে নিক্ষেপ করা হয়। কথিত আছে যে মৃত্যুর আগে তিনি ক্লাইভকে অভিশাপ দিয়েছিলেন, কারণ তিনি তার পরিবারকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন ।

কিছু সময় পর রবার্ট ক্লাইভ লুৎফুন্নেসা ও তাঁর কন্যাকে পুনরায় ঢাকায় থেকে ফিরিয়ে আনেন এবং মুর্শিদাবাদে পুনর্বাসন দেন। সিরাজের স্ত্রী লুৎফুন্নেসা মুর্শিদাবাদেই অবস্থান করেন এবং মীরজাফরের কাছ থেকে পেনশন পেতেন। ১৭৯০ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।

সিরাজ প্রশাসনিক, আর্থিক ও সামরিক সব দিক থেকেই অদক্ষ ও দুর্বল ভোগ সর্বস্য নবাব হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি পরিণতি না বুঝেই আলীবর্দী কর্তৃক নিযুক্ত সরকারি কর্মচারীদের বহিষ্কার করেন এবং তার বন্ধুদের সেখানে বসিয়ে দেন।তিনি আলীবর্দীর কন্যা ঘসেটিকে আলীবর্দীর প্রাসাদ থেকে বের করে দিয়েছিলেন এবং কখনও বহরমপুরে, কখনও পাটনায় এবং কখনও ঢাকায় তাকে থাকতে বাধ্য করেছিলেন।

ঘসেটি বুদ্ধিমতী, মনোমুগ্ধকর ছিলেন, তিনি মীর মদনের কাছ থেকে তরবারি এবং পণ্ডিতদের কাছ থেকে সংস্কৃত শিখেছিলেন। এমনকি তিনি জগৎ শেঠের ভাইয়ের কাছ থেকে মুদ্রা তৈরির কাজও শিখেছিলেন। বাংলার সুলতানা (ভাইসরয়) হওয়ার জন্য তার সমস্ত যোগ্যতা ছিল।

সিরাউদ্দৌলার পরাজয়ের পেছনে ঘসেটি বেগম ছিলেন প্রধান মদত দাতা, কারণ তিনি মানে করতেন তার স্বামী, সিরাজের থেকে অনেক যোগ্য প্রশাসক ছিলেন, এবং আলীবর্দীর (Alivardi Khan) মেয়ে হিসাবে তার অধিকার নিজামতে সবচেয়ে বেশি। ব্রিটিশরা নিজেদের বাধ্যবাধকতার কারণে যুদ্ধের পর মীরজাফরকে বাংলার নবাব (মহাসুবেদার) পদে বসায়।

মীর জাফরের মৃত্যু হয় ১৭৬৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি।

১৭৬০ সালে ৩৫ বছর বয়সে ক্লাইভ বিপুল সম্পদ নিয়ে ইংল্যান্ডে ফেরেন। তাঁর ব্যক্তিগত সম্পদ ছিল অন্তত £300,000—যা তাঁকে সে সময়কার অন্যতম ধনী ব্যক্তিতে পরিণত করে। ইংল্যান্ডে ফিরে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক Doctor of Civil Law ডিগ্রি লাভ করেন। ১৭৭৪ সালের ২২ নভেম্বর, লন্ডনের বার্কলি স্কোয়ারে তাঁর নিজস্ব প্রাসাদে (যেটি জগতসেঠের অর্থে ক্রয় করা হয়েছিল), ৪৯ বছর বয়সে নিজের হাতে ধরা ছুরির আঘাতে নিজের গলা কেটে তাঁর মৃত্যু হয়।

অত্যাচারী সিরাজউদ্দৌলার মৃত্যুর (২ জুলাই ১৭৫৭) মধ্য দিয়ে বাংলার ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে নদীয়ার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় এক বিরাট বৈদিক বজপেয় যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। বাংলার রাজনৈতিক বিপর্যয়, নবাবি শাসনের দুর্বলতা এবং ইংরেজ শক্তির ক্রমবৃদ্ধির এই সন্ধিক্ষণে কৃষ্ণচন্দ্র প্রাচীন বৈদিক ঐতিহ্যকে নতুন করে তুলে ধরতে চাইলেন। মহারাজ যজ্ঞ উপলক্ষে বাংলার নানা অঞ্চলের রাজা, জমিদার, নবাবি দরবারের অভিজাত ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানান। এমনকি নবাব মীরজাফরকেও তিনি নিমন্ত্রণ করেছিলেন। মীরজাফর নিজে আসেননি, কিন্তু সৌজন্যের নিদর্শনস্বরূপ একটি সাদা ঘোড়া এবং একটি স্বর্ণখচিত তলোয়ার প্রেরণ করেছিলেন। তাঁর আমন্ত্রণপত্র পৌঁছেছিল অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, রাঢ়, গৌড়, কাশী, দ্রাবিড়, উৎকল, কাশ্মীর প্রভৃতি অঞ্চলের বিখ্যাত বৈদিক আচার্যদের কাছে।


Leave a Reply