যদুভট্ট: রাঢ়বাংলার সংগীততীর্থ বিষ্ণুপুরের ধ্রুপদপ্রতিভা

যদুভট্ট: রাঢ়বাংলার সংগীততীর্থ বিষ্ণুপুরের ধ্রুপদপ্রতিভা

সংগীতাচার্য যদুনাথ ভট্টাচার্যর জীবন, সাধনা ও ধ্রুপদ সাধনার বিস্ময়গাথা

রাঢ়বাংলার পুণ্যভূমি বিষ্ণুপুর, যেখানকার মাটির গন্ধেই যেন ধ্রুপদের ছোঁয়া মেলে। এই ভূমিতেই ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন সংগীতসাধনার এক অপরূপ যুগপ্রতিভা—যদুনাথ ভট্টাচার্য, যিনি সংগীত জগতের পরম শ্রদ্ধেয় নাম যদুভট্ট নামে খ্যাত। তাঁর জন্ম হয় বিষ্ণুপুরের ভট্টাচার্যপাড়ায়, সেতারশিল্পী পিতা মধুসূদন ভট্টাচার্যের ঘরে। সংগীতই ছিল তাঁর শৈশবের পরিবেশ—বাড়ির আঙিনায়, প্রতিবেশীর রেওয়াজঘরে, রাজদরবারের আসরে—সর্বত্রই সংগীত ছিল শ্বাসের মতোই উপস্থিত।

যদুভট্টের শুরুর তালিম হয় পিতার হাত ধরেই—সেতার ও মৃদঙ্গ শেখার মাধ্যমে। অতঃপর গুরু রামশঙ্কর ভট্টাচার্য এবং গঙ্গানারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে তিনি গ্রহণ করেন ধ্রুপদের বিশুদ্ধ শিক্ষা। এই গুরুরাই পরবর্তীকালে সংগীত জগতে অনন্তলাল, ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী, রামকেশব ভট্টাচার্য প্রমুখ কৃতিদেরও গড়ে তোলেন। সেই সূত্রেই যদুভট্ট হয়ে ওঠেন বিষ্ণুপুর ঘরানার ধ্রুপদ সংগীতের এক মহাকাব্যিক ব্যাখ্যাতা।

তিনি শুধু কণ্ঠসংগীতেই দক্ষ ছিলেন না, বীণা, সুরবাহার, সরোদ, সেতার, এসরাজ, পাখোয়াজ, তবলা, সুরশৃঙ্গার, ন্যায়তরঙ্গ প্রভৃতি অগণিত বাদ্যযন্ত্রেও তাঁর অসাধারণ দখল ছিল। ১৪-১৫ বছর বয়সেই তাঁর প্রতিভা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, কিন্তু পিতার অকালমৃত্যু তাঁকে সাংসারিক দায়ভার নিতে বাধ্য করে। মাত্র কুড়ি বছর বয়সে তিনি বাঁকুড়ার কুচিয়াকোল রাজা রাজবল্লভ সিংহের দরবারে সংগীতাচার্যর পদে নিযুক্ত হন।

এই সময়েই তিনি সংগীত শিক্ষা দেন বিভিন্ন গুণীজনকে—যেমন মধুসূদন মুখোপাধ্যায়, মতিলাল বিদ্যাভূষণ, প্যারীচরণ দত্ত প্রমুখ। ১৮৬২ সালে কলকাতায় এসে বিখ্যাত গায়ক গঙ্গানারায়ণের কাছে খান্ডারবাণী রীতির তালিম নিয়ে নিজেকে আরও সমৃদ্ধ করেন। এরপর ১৮৬৭-৬৯ সালে তিনি সংগীততীর্থ গোয়ালিয়র ও কাশ্মীরে ঘুরে শিখে আনেন বিভিন্ন রাগের নতুন রূপ।

১৮৭০ সালে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমন্ত্রণে এক ধ্রুপদ সংগীতানুষ্ঠানে গেয়ে উপস্থিত শ্রোতাদের বিমোহিত করেন যদুভট্ট। সেই আসরে ত্রিপুরার রাজা বীরচন্দ্র মানিক্য দেব বাহাদুর তাঁর সংগীত শুনে এতটাই মুগ্ধ হন যে, সভাগায়কের পদ অলঙ্কৃত করার অনুরোধ করেন। যদুভট্ট ১৮৭৩ সাল পর্যন্ত ত্রিপুরার রাজসভায় সংগীত পরিবেশন করেন। তাঁর অনেক বন্দিশে ত্রিপুরার প্রেক্ষাপট এবং দেবদেবীর বন্দনা পাওয়া যায়।

১৮৭৪-৭৫ সালে তিনি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে সংগীত শিক্ষা দেন। আশ্বিন মাসের দুর্গোৎসবে বঙ্কিমচন্দ্রের অনুরোধে তাঁর লেখা আমার দুর্গোৎসব এবং বন্দে মাতরম্ গান দুটির সুরারোপ ও স্বরলিপি তৈরি করেন যদুভট্ট। বন্দে মাতরম্ তিনি বাঁধেন কাফি রাগে, ত্রিতালে। এই সময়েই তিনি ব্রাহ্ম সংগীত সমাজ-এর প্রধান আচার্যরূপে প্রতিষ্ঠা পান।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে তাঁর সংগীতপ্রতিভায় গভীর শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। যদিও তিনি বলেন, “আমি নিয়মিত সংগীত শিক্ষা করিনি”, তবু লেখেন—”যদুভট্টকে গাইয়ে বলে বর্ণনা করলে খাটো করা হয়। তাঁর ছিল প্রতিভা, সংগীত তাঁর চিত্তের মধ্যে যে বিশিষ্টতা ছিল তা অন্য কোন হিন্দুস্থানী গানে পাওয়া যায় না।”

তাঁর জীবন ছিল বিস্ময়ের এক অধ্যায়। একবার ত্রিপুরার রাজসভায় এক ওস্তাদ নটনারায়ণ রাগে গাওয়ার পর যদুভট্টের কাছে প্রত্যাশা করা হয় ওই একই রাগে গাওয়ার। যদুভট্টের এই রাগে কোনও পূর্বতালিম ছিল না, কিন্তু পরদিনই তিনি চৌতালে একটি নতুন বন্দিশ সুরারোপ করে গেয়ে সকলকে চমকে দেন। ঠিক এইরকমই একদিন পঞ্চকোটের বিখ্যাত বীণাশিল্পী কাশিম আলি খাঁয়ের বাদন শুনে আড়ালে থেকে রেওয়াজ করে যদুভট্ট তাঁর বন্দিশ সেতারে পরিবেশন করলে কাশিম খাঁ এতটাই মর্মাহত হন যে রাজদরবার ত্যাগ করেন।

একবার নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ্-র মেটিয়াবুরুজ দরবারে এক বাইজীর সঙ্গে গান নিয়ে বাক্‌বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন যদুভট্ট। বাইজি তাঁর সংগীতগুণে দর্শকদের আচ্ছন্ন করলেও যদুভট্ট নিজের গমক তান ও উচ্চগ্রামী শিল্পরীতিতে তাকে এবং সমস্ত সভাকে স্তম্ভিত করেন। বাইজি শেষে লজ্জিত হয়ে যদুভট্টের পায়ে লুটিয়ে পড়ে।

যদুভট্ট তাঁর সংগীতজীবনে অসংখ্য ধ্রুপদ বন্দিশ রচনা করেন। বিষ্ণুপুর ঘরানার গায়কদের কণ্ঠে এখনও তাঁর বন্দিশগুলি শোনা যায়। সুবোধরঞ্জন দে-র কণ্ঠে তাঁর অনেক বন্দিশ আজও শ্রুতিমধুর।

একটির কথা উল্লেখ করা যাক—

শম্ভু শিব মহেশ আদ ত্রিলোচন, ভব ভয় – হর ভবেশ দীননাথ
জটাজুট পিনাকী ভসম রু মালা গরলি গরে ধর হর ওড়ে বাঘাম্বর।
(রাগ: ছায়ানট, তাল: সুলফাকতা)

তাঁর রচিত গানগুলি সংকলিত হয়েছে সঙ্গীত মঞ্জরী গ্রন্থে এবং বিষ্ণুপুর নামক বইতে রামপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকাতেও কিছু গান উদ্ধৃত হয়েছে। যদুভট্টের রেখে যাওয়া স্বরলিপি ও সংগীতনোটবই আজও পঞ্চকোটের চৌধুরী-দাস-মহাপাত্রদের কাছে সংরক্ষিত।

১৮৮৩ সালে মাত্র ৪৩ বছর বয়সে যদুনাথ ভট্টাচার্যর মৃত্যু হলেও তাঁর সংগীতের মহিমা আজও অমলিন। তিনি শুধু ধ্রুপদ গায়কই ছিলেন না, বরং রাঢ়বাংলার সংগীতচেতনার এক মহাশিল্পী, যাঁর কণ্ঠে বাঙালির আত্মা ধ্বনিত হয় ধ্রুপদের স্বরলিপিতে।

4th April 2025


Leave a Reply