অখণ্ড যুক্তবঙ্গের পাকিস্তানি ফাঁদ ভেঙে হিন্দু বাঙালির নিরাপদ আশ্রয় সৃষ্টির ঐতিহাসিক প্রয়াস
জিন্না-সুরাবর্দীর যুক্তবঙ্গ প্রস্তাব আসলে বাংলার হিন্দুদের উপর এক মহাভয়ঙ্কর ফাঁদ ছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট—একটি স্বাধীন যুক্তবঙ্গ গঠন করে তা কার্যত পাকিস্তানের এক “Subsidiary State” করে তোলা। শরৎ বসু কিংবা কিরণশঙ্কর রায়ের (১৮৯১ – ১৯৪৯) মতো নেতৃবর্গ সেই মোহজালে আটকে গিয়েছিলেন, কিন্তু শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী কখনও বিভ্রান্ত হননি। তাঁর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, বিশেষত মুসলিম লীগের সাথে দীর্ঘ সহাবস্থানের ফলে, তিনি দিব্যচক্ষে বুঝতে পেরেছিলেন যে স্বাধীন যুক্তবঙ্গ মানে হিন্দুদের জন্য চিরকালের দাসত্ব।
যে দলে সামান্যতম অনুশোচনা ছিল না নোয়াখালি ও বরিশালের দাঙ্গায় (১৯৫০) হিন্দুদের উপর সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ, লুণ্ঠন ও নারীদের চরম লাঞ্ছনার জন্য, যারা প্রকাশ্যে বলেছিল যে এক দুষ্টতম মুসলমানও মহাত্মা গান্ধীর মতো হিন্দুর চেয়ে শ্রেষ্ঠ—তাদের হাতে বাংলার ভাগ্য সমর্পণ করা মানে হিন্দু সমাজকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা। তাই শ্যামাপ্রসাদ গর্জে উঠেছিলেন। তিনি সতর্ক করে বলেছিলেন, অবিভক্ত বাংলা যদি স্বাধীন রাষ্ট্র হয়, তবে তা হবে “Virtual Pakistan”—সেখানে হিন্দুরা ক্রীতদাস ব্যতীত আর কিছুই হবে না।
এই হুঁশিয়ারি তাঁর কল্পনা নয়, বরং বাস্তবতার মূর্ত প্রতিফলন। গান্ধীজী নিজে নোয়াখালিতে উপস্থিত থেকেও হিন্দু মা-বোনেদের অবমাননা রুখতে পারেননি। অগণিত নারীকে প্রতিদিন তুলে নিয়ে যাওয়া হতো, কেউ প্রতিবাদ করলে মৃত্যুর ভয় ছিল। আইন-শৃঙ্খলার নামে প্রশাসন নিস্ক্রিয়, আর দাঙ্গার নায়করা রাতারাতি সাধু-পীর ফকির সেজে মানুষকে ধোঁকা দিচ্ছিল। এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে শ্যামাপ্রসাদ উপলব্ধি করেছিলেন, অখণ্ড বাংলা মানে হিন্দুদের চরম আত্মবিসর্জন।
তাই তিনি একক নেতৃত্বে বাংলার হিন্দু সমাজকে চেতন করলেন। হিন্দু মহাসভা ছিল দুর্বল সংগঠন, কিন্তু তাঁর ব্যাক্তিত্ব, যুক্তি ও দৃঢ়তার জোরে বাংলার কংগ্রেসকেও বাংলাভাগ আন্দোলনে টেনে আনতে সক্ষম হলেন। ১৯৪৭ সালের ২০ জুন আইনসভায় বাংলাভাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ হয়—এমনকি শরৎ বসুর ভাই সতীশ বসু ও কিরণশঙ্কর রায়ও বাংলাভাগের পক্ষে ভোট দেন। জ্যোতিবসু-সহ কমিউনিস্ট সদস্যদেরও সমর্থন মেলে। শ্যামাপ্রসাদের দৃঢ় অবস্থান না থাকলে, কলকাতা হাইকোর্টও আজ করাচী বা ঢাকার মতোই পাকিস্তানের অধীনে চলে যেত—যা পরে বিচারপতি ফণিভূষণ চক্রবর্তী অকুণ্ঠভাবে স্বীকার করেছেন।
আজ পশ্চিমবঙ্গে যে হিন্দুরা নিরাপদ আশ্রয় পেয়েছে, যে প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার বুলি আওড়াতে পারছেন, তার পেছনে শ্যামাপ্রসাদের আত্মত্যাগ ও দূরদর্শিতা আছে। তিনি যদি বাংলাভাগের দাবি তুলতেন না, তবে পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের মতোই পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরাও সর্বস্ব খুইয়ে উদ্বাস্তুতে পরিণত হতো। নোয়াখালির অসহায় মা-বোনেরা যেমন পুলিশের সামনে দাঁড়িয়েও কাঁদতে কাঁদতে নিজেদের দুঃখগাথা বলতে পারেননি, তেমনি তখন গোটা হিন্দু সমাজকে দাসত্ব মেনে নিতে হতো।
তাই তাঁর বিখ্যাত উক্তি—“You divided India, I divided Pakistan”—শুধু দম্ভোক্তি নয়, নির্ভেজাল ঐতিহাসিক সত্য। জিন্নার ‘মথ-ইটেন পাকিস্তান’-এর জন্মে শ্যামাপ্রসাদের অবদান অনস্বীকার্য। হিন্দু সমাজের অস্তিত্ব ও আত্মসম্মান রক্ষার জন্য বাংলাভাগই ছিল একমাত্র যুক্তিসঙ্গত পথ। শ্যামাপ্রসাদের নেতৃত্বে সেই আন্দোলন সফল হওয়ায় আজ পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরা নিজেদের সংস্কৃতি, ধর্ম, ভাষা ও মানমর্যাদা রক্ষা করে বেঁচে থাকতে পারছে। তাই তাঁর আন্দোলনকে অন্যায় বা বিভাজনবাদী বলা নয়, বরং বাংলার হিন্দু জাতিসত্তার পরিত্রাণ হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত করা উচিত।
১লা জুলাই ২০২৫