রামি–চণ্ডীদাস

রামি–চণ্ডীদাস

বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের বিশ্বকোষ (Encyclopedia of Bengali Language and Literature)

তন্ময় ভট্টাচার্য (অ্যাডভোকেট)

“সবার উপরে মানুষ সত্য
তাহার উপরে নাই।”

বাঙালি পদকর্তা চণ্ডীদাস বর্তমান বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি শুদ্ধ ভক্তিতে নির্বিকল্প প্রেমের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। চৈতন্য তাঁর দ্বারা মুগ্ধ হয়েছিলেন।

চণ্ডীদাস ও রামি রজকিনির গ্রাম মাগুরা জেলার (বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে) শতখালি গ্রাম। এই গ্রামেই চণ্ডীদাস আর রজকিনির ঘাট, তাঁদের ভিটা ও নদীর ঘাট এখনো আছে। চণ্ডীদাস (১৩৩০ খ্রিস্টাব্দ–১৩৮০ খ্রিস্টাব্দ) ও রজকিনি রামির প্রেমকাহিনি আজও লোকমুখে বেঁচে আছে। বাংলাদেশের মাগুরা জেলার ধোপাখালি গ্রামের সঙ্গেই যুক্ত এই কাহিনি। শতখালি আর ধোপাখালি গ্রামের মাঝ দিয়ে বয়ে যেত একটি নদী, বর্তমানে যেটি “দুয়া” নামে পরিচিত। চণ্ডীদাস ছিলেন বসুলি বা মনসাদেবীর উপাসক। ধোপাখালি গ্রামের প্রবেশমুখে ছিল একটি গোপাল মন্দির, সেখানে রজকিনি রামি দাসী হিসাবে কাজ করতেন।

বারো বছর নীরব সাক্ষাতের পর তাঁরা একে অপরের কাছে প্রেম স্বীকার করেন। কিন্তু সমাজ তাঁদের সম্পর্ক মেনে নেয়নি। বাধ্য হয়ে তাঁরা পালিয়ে যান বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার নানুরে। সেখান থেকে তাঁরা বৃন্দাবনে গিয়েছিলেন এবং সেখানেই দু’জনের একসঙ্গে মৃত্যু হয়।

শুন রজকিনী রামি
ও দুটি চরণ শীতল জানিয়া
শরণ ল‌ইনু আমি ।।

চণ্ডীদাসের পিতা ছিলেন শতখালি গ্রামের একজন ব্রাহ্মণ জমিদার। আর ঠিক বিপরীত পাশে ধোপাখালি গ্রামে থাকত ধোপা বা রজকদের পরিবার। মাঝখান দিয়ে বয়ে যেত সেই নদী, যা আজও টিকে আছে।

তবে উল্লেখযোগ্য যে বড়ু কবি চণ্ডীদাসের জন্মস্থান বাঁকুড়া জেলার ছাতনা গ্রামে। তিনি ছিলেন অন্য ব্যক্তি। তাই চণ্ডীদাসের বিভ্রান্তি এড়াতে এই প্রেমকাহিনির নায়ককে “রামি-চণ্ডীদাস” নামে আলাদা করে চিহ্নিত করা হয়।

একে কুলবতী ধনি তাহে সে অবলা।
ঠেকিল বিষম প্রেমে কত সবে জ্বালা।।
অকথন বেয়াধি কহন নাহি যায়।
যে করে কানুর নাম ধরে তার পায়।।
পায়ে ধরি কাঁদে সে চিকুর গড়ি যায়।
সোনার পুতলি যেন ভূমেতে লোটায়।।
পুছয়ে কানুর কথা ছল ছল আঁখি।
কোথায় দেখিলা শ্যাম কহ দেখি সখি।।
চণ্ডীদাস বলে কাঁদে কিসের লাগিয়া।
সে কালা আছয়ে তার হৃদয়ে জাগিয়া।

এমন পিরীতি কভু নাহি দেখি শুনি।
পরাণে পরাণে বান্ধা আপনা আপনি।।
দুহুঁ কোরে দুহুঁ কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া।
আধ তিল না দেখিলে যায় যে মরিয়া।।
জল বিনু মীন যেন কবহু না জীয়ে।
মানুষে এমন প্রেম কোথা না শুনিয়ে।।
ভানু-কমল বলি সেহো হেন নয়।
হিমে কমল মরে ভানু সুখে রয়।।
চাতক-জলদ কহি সে নহে তুলনা।
সময় নহিলে সে না দেয় এক কণা।।
কুসুমে মধুপ কহি সেহো নহে তুল।
না যাইলে ভ্রমর আপনি না দেয় ফুল।।
কি ছাড় চকোর-চান্দ দুহুঁ সম নহে।
ত্রিভুবনে হেন নাহি চণ্ডীদাসে কহে।।

এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা
কেমনে আইল বাটে।
আঙ্গিনার মাঝে বঁধুয়া ভিজিছে
দেখিয়া পরাণ ফাটে।।
সই, কি আর বলিব তোরে।
কোন পুণ্যফলে সে হেন বঁধুয়া
আসিয়া মিলল মোর।।
ঘরে গুরুজন ননদী দারুণ
বিলম্বে বাহির হৈনু।
আহা মরি মরি সঙ্কেত করিয়া
কত না যাতনা দিনু।।
বঁধুর পিরীতি আরতি দেখিয়া
মোর মনে হেন করে।বড়ু কবিবড়ু কবি
কলঙ্কের ডালি মাথায় করিয়া
আনল ভেজাই ঘরে।।
আপনার দুখ সুখ করি মানে
আমার দুখের দুখী।
চণ্ডীদাস কহে বঁধুর পিরীতি
শুনিতে জগত সুখী।।

রামি–চণ্ডীদাস সম্পর্কে আলোচনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে রাখতে হয় যে ইতিহাসে একাধিক চণ্ডীদাসের উল্লেখ পাওয়া যায়। এখানে যে চণ্ডীদাসকে বলা হচ্ছে তিনি হলেন রামি–চণ্ডীদাস, আর বাকিরা ছিলেন চৈতন্যোত্তর যুগের। রামি–চণ্ডীদাস কখনোই সরাসরি রাধা সম্পর্কে লেখেননি; তাঁর কাব্যের ধারা ছিল বোপদেবের ভাগবত পুরাণ-নির্ভর ভক্তিসাহিত্য। একই রকম বিভ্রান্তি বিদ্যাপতির ক্ষেত্রেও ঘটে। মৈথিলি বিদ্যাপতির আগে অন্তত চারজন খ্যাতিমান বিদ্যাপতির নাম শোনা যায়। আভিনব গুপ্ত ১০১৫ খ্রিস্টাব্দেই এক বিদ্যাপতির উল্লেখ করেছেন।

দীন চণ্ডীদাসের জন্ম চৈতন্যদেবের মৃত্যুর অন্তত সত্তর বছর পরে, এবং তিনি রূপ গোস্বামীর মাঞ্জরী উপাসনা দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। রামি–চণ্ডীদাসের সময়কালে দিল্লির সুলতান ছিলেন মুহাম্মদ বিন তুঘলক। রামি–চণ্ডীদাসের রচনায় শারীরিক প্রেমের কোনো স্থান ছিল না। সেখানে ছিল শৃঙ্গার রস, তবে তা ছিল নির্বিকल्प প্রেম—যেখানে প্রেম একান্তই আত্মিক ও আধ্যাত্মিক, শুদ্ধ ভক্তির প্রকাশ।

সুধা ছানিয়া কেবা ও সুধা ঢেলেছে রে
তেমতি শ্যামের চিকণ দেহা |
অঞ্জন রঞ্জিয়া কেবা খঞ্জন বসাইল রে
চাঁদ নিঙ্গাড়ি কৈল থেহা ||
থেহা নিঙ্গাড়িয়া কেবা মুখানি বনাইল রে
জবা নিঙ্গাড়িয়া কৈল গণ্ড |
বিম্বফল জিনি কেবা ওষ্ঠ গড়িল রে
ভুজ জিনিয়া করিশুণ্ড ||
কম্বু জিনিয়া কেবা কণ্ঠ বনাইল রে
কোকিল জিনিয়া সুস্বর |
আরদ্র মাখিয়া কেবা সারদ্র বনাইল রে
ঐছন দেখি পীতম্বর ||
বিস্তারি পাষাণে কেবা রতন বসাইল রে
এমতি লাগয়ে বুকের শোভা |
কানড়-কুসুমে কেবা সুষম করিল রে
এমতি তনুর দেখি আভা ||
আদলি উপরে কেবা কদলী রোপল রে
ঐছন দেখি ঊরুযুগ |
অঙ্গুলি উপরে কেবা দর্পণ বসাইল রে
চণ্ডীদাস দেখে যুগ যুগ ||

এমন পিরীতি কভু দেখি নাই শুনি |
পরাণে পরাণ বাঁধা আপনা আপনি ||
দুহুঁ কোরে দুহুঁ কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া |
তিল আধ না দেখিলে যায় যে মরিয়া ||
জল বিনু মীন জনু কবহুঁ না জীয়ে |
মানুষে এমন প্রেম কোথা না শুনিয়ে ||
দুগ্ধে আর জলে প্রেম কিছু নাহি স্থির |
উথলি উঠিলে দুগ্ধ জল পাইলে ধীর ||
ভানু কমল বলি সেহ হেন নহে |
হিমে কমল মরে ভানু সুখে রহে ||
চাতক জলদ কহি সে নহে তুলনা |
সময় নহিলে সে না দেয় এক কণা ||
কুসুমে মধুপে কহি সেহ নহি তুল |
না আইলে ভ্রমর আপনি না যায় ফুল ||
কি ছার চকোর চাঁদ দুহুঁ সম নহে |
ত্রিভূবনে হেন নাহি চণ্ডীদাস কহে ||

জনম গেল পর দুঃখে কত বা সহিব।
কানু কানু করি কত নিশি পোহাইব।।
অন্তরে রহিল ব্যথা কুলে কি করিবে।
অনুরাগে কোন দিন গরল ভখিবে।।
মনেতে করেছি কুলে দিব তিলাঞ্জলী।
দেশান্তরি হ’ব গুরু দিঠে দিয়া বালি।।
ছাড়িনু গৃহের সাধ কানুর লাগিয়া।
পাইনু উচিৎ ফল আগে না বুঝিয়া।।
অবলা কি জানে এমত হইবে পাছে।
তবে এমন প্রেম করিবে কেন যেচে।।
ভাল মন্দ না জানিয়া সুঁপেছি হে মন।
তেঞি সে অনলে পুড়ি যায় দেহ প্রাণ।।
চণ্ডীদাস কয় প্রেম হয় সুধাময়।
কপাল ক্রমে অমৃতেতে বিষ উপজয়।।


Leave a Reply