গঙ্গেশোপাধ্যায় কৃত তত্ত্বচিন্তামণি গ্রন্থে ‘মঙ্গলবাদ’

গঙ্গেশোপাধ্যায় কৃত তত্ত্বচিন্তামণি গ্রন্থে 'মঙ্গলবাদ'

তত্ত্বচিন্তামণি গ্রন্থে ‘মঙ্গলবাদ’

গঙ্গেশোপাধ্যায় (দ্বাদশ শতাব্দী)

তত্ত্বচিন্তামণি’ — ইত্যাদি কেবল এক গ্রন্থনাম নহে, বরং এক গভীর দার্শনিক পথচিন্তার প্রতীক। ‘তত্ত্ব’ শব্দে বোধিত হয় সেই পরম সত্য, যাহা সর্বসত্তার মূল, আর ‘চিন্তামণি’ দ্বারা বোধিত হয় সেই নির্মল মনবুদ্ধি, যাহা সক্রিয়, ধ্যাননিষ্ঠ, বিশ্লেষণক্ষম ও নিরুপাপ্লব বিশুদ্ধতায় পূর্ণ।

এই দার্শনিক সূত্র অনুসারে, চিন্তামণি মানস-রত্ন; ইহা সেই স্বচ্ছ ও নিবিষ্ট মন, যাহা দৃশ্যমান ও সংজ্ঞায়িত জগতের বিভিন্ন রূপসমূহকে শ্রেণীভুক্ত করিয়া, যথাযথ নিযুক্ত চিন্তন, যুক্তি, ও মনন-এর দ্বারা তাহা বিশ্লেষণপূর্বক সেই ‘তৎ’ বা পরমতত্ত্বে উপনীত হইতে সমর্থ হয়। এই ‘মন’ হইল চিতি-র এক গতিশীল অভিব্যক্তি; ‘চিৎ‘ যদিও স্বভাবে অচল, অসংজ্ঞেয় ও অব্যাখ্যেয়, তথাপি ইহা বিভিন্ন রূপে, বিভাগে, ও তত্ত্বে প্রকাশিত হইয়া জগৎরূপে অভিমত হয়।

এই ব্যাখ্যানুসারে তত্ত্বচিন্তামণি হইল — ‘চিতির’ অতন্দ্র স্বচ্ছাবস্থা, যাহা সকল বিভাজ্য ও বিভাগরূপ জগতকে উপলব্ধি করিয়া, তাহার অন্তরস্থ একত্ব-তত্ত্বের প্রতি মনন-যোগে আরোহণ করে।

এই দার্শনিক ভাবনা ও ব্যাখ্যা বাসুদেব সার্বভৌম, গৌরাঙ্গ মিশ্র, রঘুনাথ শিরোমণি, গদাধর ভট্টাচার্য, জগদীশ তর্কালঙ্কার, মথুরানাথ তর্কতীর্থ, প্রমুখ নব্যন্যায়াচার্যগণের দ্বারা গ্রহণ ও স্বীকৃত হইয়াছিল।

আমরা তত্ত্বচিন্তামণি অনুবাদ করিতেছি কাশীর পণ্ডিতমণ্ডলীতে বিশেষভাবে গৃহীত মহামহোপাধ্যায় বামাচরণ ভট্টাচার্য (১৮৯৯-১৯৫৯)-প্রবর্তিত ভাষ্যধারা অনুসরণ করিয়া। বাঙ্গালিটোলার বিশিষ্ট পণ্ডিত সাহিত্যাচার্য বিশ্বনাথ ভট্টাচার্যএর নিকট হইতে আমরা যেরূপ অনুপ্রেরণা প্রাপ্ত হইয়াছি, তাহা চিরকাল আমাদের কৃতজ্ঞতাপূর্বক স্মরণীয় থাকিবে।

এইভাবে, তত্ত্বচিন্তামণি হইল এক মানসিক প্রক্রিয়া (প্রামাণ্য), যাহাতে চিতি নিজ দিগ্দিগন্তরূপ বিভাজিত প্রকাশকে নিজস্ব অখণ্ড-স্বরূপে চিন্তন-দ্বারা উপলব্ধ করে— এবং মনই সেই ‘মণি’, যাহার দীপ্তি হইতে বিচ্ছিন্নতা, ভেদ ও বিভ্রান্তি লয়প্রাপ্ত হয়,ইত্যাদি।

তন্ময় ভট্টাচার্য

তত্ত্বচিন্তামণি মঙ্গলবাদ সারসংক্ষেপ

শাস্ত্রচর্চার প্রারম্ভে মঙ্গলাচরণ এক প্রাচীন ও প্রচলিত রীতি, যাহা শিষ্ট সমাজে বহুলব্যবহৃত। কিন্তু শ্রীগঙ্গেশ উপাধ্যায় এই প্রচলিত রীতির নব্যনৈয়ায়িক বিশ্লেষণ দান করিয়া প্রশ্ন করেন—মঙ্গল কি আদৌ শাস্ত্রগত অনিবাৰ্য অঙ্গবিশেষ, না কেবলমাত্র এক শিষ্টাচার-নির্ভর ঐচ্ছিক ক্রিয়া?

তাঁহার বিশ্লেষণ অনুসারে, কাহারো কোন কর্ম আরম্ভ করিবার সময় ও তাহার সিদ্ধি কামনার অভিপ্রায়ে যেই ‘মঙ্গলাচরণ’ কৃত হয়, তাহা মূলতঃ কোন কর্মফলের সরাসরি উত্পাদক নহে; বরং সম্ভাব্য প্রতিবন্ধকতা অপনোদন করিবার এক উপায়মাত্র। অর্থাৎ, মঙ্গলাচরণ স্বয়ং কিছু সৃষ্টি করে না, কিন্তু কর্মসিদ্ধির বিঘ্নস্বরূপ দুষ্টপ্রবাহ অথবা দোষকে দূর করিবার উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত হয়।

তদ্ব্যতীত, গঙ্গেশ উপাধ্যায় দেখাইয়াছেন যে—

  • মঙ্গলাচরণের দ্বারা নৈয়ায়িক অর্থে প্রত্যক্ষ বা অব্যবহিত কোন ফল প্রাপ্ত হয় না;
  • কখনো কখনো মঙ্গল না করিয়াও কর্মসিদ্ধি হইতে দেখা যায়;
  • আবার অনেক সময় মঙ্গল করিয়াও কর্ম ব্যর্থ হয়।

এইসব যুক্তি লইয়া তিনি সিদ্ধান্ত প্রদান করেন যে—মঙ্গল কোন শাস্ত্রনির্দেশিত “অঙ্গ” নহে; তাহা তো “প্রধান” পদবাচ্য হইবার প্রশ্নই ওঠে না। বরং ইহা একপ্রকার প্রার্থনানির্ভর শিষ্টাচারমূলক আচার, যাহা কর্মের মধ্যে সম্ভাব্য প্রতিবন্ধকতাকে হ্রাস করিয়া, তাহার অনায়াস ও নির্বিঘ্ন সমাপ্তির সম্ভাবনাকে বর্ধিত করিতে পারে।

তাঁহার মতে, যিনি নিজ কর্মে সিদ্ধিলাভ করিতে চাহেন এবং যাঁহার মনে সাফল্যলাভের আকুল আকাঙ্ক্ষা রহিয়াছে, তিনিই নিয়মবদ্ধভাবে মঙ্গল আচরণ করেন। পক্ষান্তরে, যাঁহারা শাস্ত্র মানেন না বা নাস্তিক, তাহারাও কখনো মঙ্গল না করিয়াই সাফল্য পাইতে পারেন—কিন্তু ইহা মঙ্গলের ফলে নহে, বরং জন্মান্তরস্থিত পুণ্যফল বা অন্যান্য অজ্ঞাত কারণবশত ঘটিত হয়।

তিনি আরও বলেন—যেমন প্রায়শ্চিত্ত দোষনাশক একটি প্রক্রিয়া, ফলবাহী নহে,
তদ্রূপ মঙ্গলাচরণও এক বিশেষ কর্ম-সহায়ী দোষনিবারক মাত্র;
তাহার ফল হইল—“বিঘ্নহীনতা”,
কিন্তু তাহা কোন সরাসরি ফলদানকারী শাস্ত্রবিধেয় ক্রিয়া নহে।

সুতরাং গঙ্গেশ উপাধ্যায় ইহা প্রতিপন্ন করেন যে—মঙ্গল শাস্ত্রের অঙ্গ নহে, প্রধান তো নহেই; বরং ইহা একপ্রকার সহায়ক প্রার্থনাত্মক আচার, যাহা প্রায়শ্চিত্তের ন্যায় কর্মসিদ্ধির পথ সুগম করিতে পারে, কিন্তু নিজে কখনো ফলবাহী নহে।

গঙ্গেশোপাধ্যায়-রচিত তত্ত্বচিন্তামণি গ্রন্থের প্রত্যক্ষখণ্ডে মঙ্গলবাদসিদ্ধান্ত

श्रीमद्गङ्गेशोपाध्यायविरचितःतत्त्वचिन्तामणिः
प्रत्यक्षखण्डः

मङ्गलवादः

यतो मणेः पण्डितमण्डनक्रिया
प्रचण्डपाषण्डतमस्तिरस्क्रिया ।
विपक्षपक्षे न विचारचातुरी
न च स्वसिद्धान्तवचोदरिद्रता ॥

যেহেতু এই “মণি” (তত্ত্বচিন্তামণি) হইতে—
পাণ্ডিত্যসাধনার সকল দিশা পরিপূর্ণ হইয়া উঠে;
প্রচণ্ড পাষণ্ড্যতামসের উচ্ছেদ সাধিত হয়;
প্রতিপক্ষ ও স্বপক্ষ—উভয় ক্ষেত্রেই গভীর বিশ্লেষণশক্তি দৃষ্ট হয়;
নিজস্ব সিদ্ধান্তপ্রতিপাদনেও বাক্যদারিদ্র্যের কোন চিহ্ন দেখা যায় না।

মঙ্গলবাদ অধ্যায়ের পূর্বপক্ষ

সকল শিষ্ট ও গম্ভীর পণ্ডিতগণ কার্যারম্ভের কালে কার্যের সদ্‌সমাপ্তির আশায় মঙ্গলকার্য আচার করেন (इह खलु सकलशिष्टैकवाक्यतया अभिमतकर्मारम्भसमये तत्समाप्तिकामा मङ्गलमाचरन्ति ।)। যদিও এই মঙ্গলের কারণস্বরূপতা কোনোক্রমেই নিত্যঅন্বয় বা ব্যতিরেক দ্বারা নির্ধারিত নহে, তথাপি মঙ্গলবিহীনভাবে কোনো কর্মও সম্পূর্ণ হইতে দেখা যায়। একে জন্মান্তরসঞ্জাত পুন্যফল বলিয়া ভাবিলেও, তদপেক্ষিতব্য কারণসমূহ অন্যোন্যাশ্রয় ও লোকসিদ্ধ কারণবিচারবিরুদ্ধ বলিয়া গণ্য হয়। উপরন্তু, মঙ্গল আচরণ না করিলে ফল নিষ্ফল হইবে, ইহা ও অনুপপন্ন; কেননা নিষ্ফলতা নির্দিষ্ট নহে, ফলসিদ্ধির সময় মঙ্গল উপস্থিত থাকা স্বাভাবিক, অন্য ফলের ভিন্নতা উপলব্ধ নহে, বিশ্বজিত্‌-নিয়ম অনুসারে মঙ্গলের ফলকল্পনা গুরুতর হইয়া পড়ে। অতএব, পরিশিষ্ট অনুমানের দ্বারা মঙ্গলের কারণত্ব নির্ধারিত হইয়া থাকে।

কারণ হেতু ব্যতিক্রমের দ্বারা যাহা ধৃত হয় না, তাহা সহস্র উপায়েও গ্রহণযোগ্য নহে। তবু, যেহেতু প্রাচীন শিষ্ট সমাজে মঙ্গলের উদ্দেশ্য সমাপ্তিকারিতা বলিয়া অনুমিত, এবং শাস্ত্রত তাহার ইঙ্গিত আছে, সেহেতু মঙ্গলের হেতুত্ব স্বীকৃত হয়।

এই মঙ্গল কর্মারম্ভের এক অঙ্গ স্বরূপ, কারণ কর্মার্থতায় শিষ্টজনগণ তাহা পূর্বে আচরণ করেন। অন্য ফল না থাকিলে ও ফলবান কর্মারম্ভের কালে মঙ্গল পূর্বে সম্পাদিত হয়, যেরূপ দর্শয়াগে প্রয়াজাদি। আচরণমূলক শ্রুতি ও অনুমান দ্বারা মঙ্গল ফলাকাঙ্ক্ষা বুঝায়, ফলবতী কর্মফলরূপে তাহার উপাদানতাও প্রমাণিত।

অতএব, এই মঙ্গল আচরণ কর্মারম্ভে নিয়মত অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে। যদিও মঙ্গল অলৌকিক, তথাপি ইহা লোকাভিজ্ঞ কারণে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, যেমত গৃহরথ ইত্যাদি কার্যের ক্ষেত্রে। অতএব, দর্শপূর্ণমাস প্রভৃতি যজ্ঞে মঙ্গল আচার নিয়মত অনুষ্ঠিত হয়।

তবে, মঙ্গল যজ্ঞবৎ অদৃষ্টদ্বারা নিষিদ্ধতা দূর করিয়া ফল আনয়ন করে না; বরং ইহা বাধাবিহীনতারূপ সহায়তা প্রদান করে। মঙ্গল কর্মকে অদৃশ্যপথে সমাপ্তিতে সহায়তা করে, সরাসরি যজ্ঞাঙ্গ্যের মত অদৃষ্ট উৎপাদক নহে। মঙ্গল অনুষ্ঠান ব্যতীত কর্মও সম্পন্ন হইতে পারে, তবে শিষ্টরা মঙ্গল অনুষ্ঠান করে থাকেন “নির্বিঘ্ন সমাপন” আশায়। সেই কারণে, যাহা ভবিষ্যৎবিঘ্ন সন্দেহজনিত, তাহার নাশার্থে মঙ্গল এক স্বাভাবিক আচরণরূপে গৃহীত।

এবং অনেকে বলেন, মঙ্গল প্রধান হইয়া থাকে; তাহার দ্বারা উৎপন্ন অদৃষ্টই কর্মসমাপ্তির কারণ। যাহা কেহই প্রত্যক্ষ করে না, কিন্তু যাহা ফলসিদ্ধির কারণ বলিয়া গৃহীত হয়, তাহাই অদৃষ্ট। এহেন অদৃষ্টই কর্মফলসিদ্ধির অন্তঃকারণ। এবং এই মঙ্গলের অনুষ্ঠানে এমন অদৃষ্ট উৎপন্ন হয়।

কিন্তু, দেখা যায় অনেক সময় মঙ্গল আচরণ ব্যতিরেকেও কর্ম সম্পন্ন হইয়াছে। তাহা হইলে, জন্মান্তরসঞ্চিত পুন্য বা অন্য কোন অজ্ঞাত হেতুই সেক্ষেত্রে কার্যকর। কিন্তু তদ্বিষয়ে স্থির ও সাধারণ নিয়ম নাই; কখনো মঙ্গল, কখনো পুন্য—এইরূপ দ্বৈত সম্ভাবনাও শাস্ত্রানুগ নহে।

অতএব, পূর্বপক্ষকার মতানুসারে মঙ্গল না অঙ্গ, না প্রধান; ইহা একরূপ আরম্ভকালে আচরিত আচার মাত্র। এহেন মতই পূর্বপক্ষ

इति मङ्गलवादपूर्वपक्षः

গঙ্গেশোপাধ্যায়-রচিত তত্ত্বচিন্তামণি গ্রন্থের প্রত্যক্ষখণ্ডে মঙ্গলবাদসিদ্ধান্ত অংশ

মঙ্গলবাদসিদ্ধান্ত

এখন আসা যাক মূল সিদ্ধান্তে

কার্যারম্ভের সময় যাহা মঙ্গলরূপে আচরিত হয়, তাহা কর্মসমাপ্তির জন্য কোনও অঙ্গ নহে, প্রধানও নহে, কারণ তাহা কার্যফলসাধনে হেতু নহে। বরং, প্রায়শ্চিত্তের ন্যায় ইহা একটি বিশিষ্ট কার্যবিশেষ, যাহার ফল হইতেছে “বিঘ্ন বিনাশ”। এই মঙ্গলের উদ্দেশ্য এই যে, কর্মসমাপ্তিতে কোনও বিঘ্ন না ঘটে। কর্মপথে যেকোনো সম্ভাব্য বাধা যেন না আসে—এই কামনা হইতেই ইহার অনুষ্ঠান হইয়া থাকে।

যদি বিঘ্নের বিষয়ে সন্দেহ বা নিশ্চিত ধারণা থাকে, তাহা হইলেও শিষ্টজনেরা মঙ্গল আচরণ করিয়া থাকেন, যেহেতু সকলেই বিঘ্নবিরহের আকাঙ্ক্ষা রাখেন। যদি বলা যায়—“নির্বিঘ্নে সমাপন হউক” এইরূপ কামনাতেই মঙ্গল করা হয়—তাহা হইলেও মঙ্গল নিজে ফল নহে; যেমন, “আমি স্বর্গে যাই” এই কামনায় ‘স্বর্গ’ ফল, ‘আমি’ নহে। বিঘ্নবিরহই ফল, মঙ্গল নহে। কেননা, কর্মসমাপ্তি নিজেই শাস্ত্রবিধি ও লোকোপলব্ধির নির্ভরযোগ্য কারণে সংঘটিত হইয়া থাকে।

যে সকল মঙ্গল—যেমন দেবতার স্তুতি, হোম, নমস্কার প্রভৃতি—তাহা প্রত্যেকটি বিঘ্ন বিনাশ সাধন কারক। এই কারণে, শাস্ত্রসম্মতভাবে মঙ্গলের ফলনিশ্চয় থাকায় তাহার অনুশীলন। শাস্ত্র কখনো অবিশ্বস্ত হয় না।

তবু, কর্ম অসমাপ্ত হয় কিছু ক্ষেত্রে—পুরাতন প্রবল বিঘ্নের জন্য, অথবা মঙ্গল অনুসরণ করিয়াও যদি পরে বিঘ্ন উৎপন্ন হয়, অথবা মঙ্গলের পর কিছু লোকবুদ্ধিতে স্বীকৃত কারণ অনুপস্থিত থাকে। তবে, যিনি বিঘ্নের বিলোপ কামনা করেন, তাহার পক্ষে মঙ্গল অনিবার্য; মঙ্গল ব্যতীত সেই কামনার পূরণ ঘটিবে না। কারণ, বিঘ্নরূপ প্রতিবন্ধক বিলোপের মাধ্যমরূপে মঙ্গল অনিবার্য।

শাস্ত্রবিধান অনুসারে, নিয়তকালের শিষ্টআচার থেকে অনুমান করিয়া জানিতে পারি যে, কর্মারম্ভের সময় মঙ্গল অনিবার্য কর্তব্য। যেমন, দর্শযজ্ঞ আরম্ভে যে মঙ্গল আচরণ হয়, তাহা সেই সময়েই নির্দিষ্ট।

এমনও হয়, বিঘ্ন না থাকিলে ফল স্বতঃসিদ্ধ হয়। আবার, কখনো বিঘ্ন স্বতঃসিদ্ধ নহে; মঙ্গল করিলে তাহা দূর হয়। সুতরাং, দেখা যায়, মঙ্গল না থাকিলেও যদি জন্মান্তরের কোনো বিঘ্ন একান্তভাবে অনুপস্থিত হইয়া থাকে, তাহা হইলেও নাস্তিক বা অপ্রস্তুত ব্যক্তির কার্য সমাপ্ত হইতে পারে।

এহেন অবস্থায় এই প্রশ্ন উঠে—মঙ্গল আচরণের ‘মঙ্গল’ বলিয়া স্বরূপ কী? ইহা কি দেবতাস্তবাদি? তাহা অননুগম্য। ইহা কি উদ্দেশ্য বিঘ্ন নাশক কার্য? তাহাও স্পষ্ট নহে। কারণ, দেবতাস্তব প্রভৃতি কোনো বিশেষ ক্রিয়া বা পদ্মূলে এমন কোনো কারণরূপে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত হয় নাই যাহা সাধারণ বিঘ্ননাশক হইতে পৃথক হইয়া উঠে। তাহার কার্যরূপ বিশেষত্ব শাস্ত্রে স্পষ্ট নহে।

অতএব, বলা হইয়াছে—‘মঙ্গলমাচরেত্‌’ ইহা কোন ‘বিধি’ বাক্য নহে। বরং, ‘যিনি নির্বিঘ্ন সমাপ্তি চান, তিনি দৈবত্ত্ব স্তব করেন’—এইরূপ পৃথক পৃথক ক্রিয়া ও বিধির দ্বারা ইহা বর্ণিত। এইরূপই শিষ্টআচার থেকেও প্রতিভাত হয়। সেই আচরণ অবলম্বনে এবং ‘নির্বিঘ্নে শেষ হউক’—এই কামনায়, যেহেতু বিঘ্ননাশক হেতু বলিয়া ভিন্নতর কার্যরূপে ইহা অভিহিত, সেই কারণেই মঙ্গলরূপে আচরণ করিতে হয়।

এই জন্যই, গঙ্গাস্নান বা অন্য দুষ্টিনাশকারী কর্ম মঙ্গল নহে; কেননা শাস্ত্রে তাহা মঙ্গল বলিয়া নির্ধারিত নহে।

শাস্ত্রবাক্যে বলা হইয়াছে—
“যে সকল ব্যক্তি সর্বদা মঙ্গলাচারে, নিয়ত বিশুদ্ধচিত্ত ও জপ-হোম প্রভৃতিতে রত, তাহার কোন অপতন হয় না।”

मङ्गलाचारयुक्तानां नित्यं च प्रयतात्मनाम्।
जपतां जुह्वतां चैव विनिपातो न विद्यते —

ইহা দ্বারা বোঝা যায়, মঙ্গলের পৃথক ফল আছে, শুধুমাত্র বিঘ্ননিবারণ নহে। যদি তাহা হইত, তবে গ্রন্থারম্ভে ‘নমস্কার’ মতো আচরণও মঙ্গল হইত, যাহা গ্রহণযোগ্য নহে।

আবার ‘অথ’ শব্দও মঙ্গল সূচক (अथशब्दो विघ्ननिवर्तकत्वान्मङ्गलमेव) । স্মৃতিতে আছে—“ওঙ্কার ও অথ—এই দুইটি ব্রহ্মার কণ্ঠ হইতে উৎপন্ন, তাই উভয়ই মাঙ্গলিক।”(ओंकारश्चाथशब्दश्च द्वावेतौ ब्रह्मणः पुरा । कण्ठं भित्वा विनिर्यातौ तेन माङ्गलिकावुभौ)

অতএব, উহা শুভসূচকতা নয়, শাস্ত্রারম্ভে ‘অথ’ ইত্যাদি মহর্ষি কর্তৃক শুভসূচক না করিবার সম্ভাবনাও থাকিয়া যায়।

মঙ্গলার্থে যাহা যাহা কৃত হয়, তাহা কোনও এক বিশেষ দেবতার উদ্দেশে প্রশংসা হইয়া থাকে (गुणवत्तया ज्ञापनं स्तुतिः)। সেই প্রশংসা, মানসিক বা বাচিক বা শারীরিক যে-রূপেই হউক না কেন, ইহা স্বতন্ত্র এক পদার্থরূপে অভিজ্ঞতালব্ধ। শুধুমাত্র হস্তমেলানো বা কপাল ছোঁয়া নয়—“আমি আপনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল” বলিয়া বোধরূপেই তাহার তাৎপর্য ধৃত হইয়া থাকে।

তবে, কেহ বলিতে পারে—যদি শারীরিক কায়িক-ক্রিয়ার পেছনে মানসিক প্রস্তুতি না থাকে, তবে কায়িক কর্ম অর্থহীন। ইহা সত্য নহে। কারণ, কর্মরূপ বাচিক-কায়িক কার্যমান বোঝা যায়।

তবে শিষ্টতা নির্ধারণকর্তা কে? যে ব্যক্তি স্বীকৃতভাবে বৈদিক শাস্ত্র মানিয়া চলে, এবং যাহার আচরণ ও ক্রিয়া শাস্ত্রবিরুদ্ধ নহে, তিনিই শিষ্ট। এই শিষ্টতা জন্মায় অশাস্ত্রপন্থী পন্থা বর্জনের মাধ্যমে। পাণ্ডিত্য বা স্মৃতি জ্ঞানের ভিত্তিতে নয়, শাস্ত্রানুসরণই মূল।

পূর্বকালে যাঁহারা—যেমন মনু প্রভৃতি—সম্পূর্ণ শুদ্ধ আচরণ করিয়াছেন, তাঁহাদের আচারই বর্তমান সমাজে শিষ্টাচাররূপে গৃহীত। অতএব আধুনিক ব্যক্তিগণের (आधुनिकानामाचारेण) আচরণ যদি শুদ্ধ হয়, তাহা শিষ্ট মানিয়া শাস্ত্র ব্যাখ্যা হয়।

শেষে বলা যায়—যদি কোনও আচরণ শুদ্ধ ও শাস্ত্রবিরুদ্ধ না হয়, এবং শাস্ত্রবাক্য তাহাকে নিষিদ্ধ না করে, তবে সেই আচরণ হইতে শাস্ত্র অনুমান হয়। এই রূপেই মঙ্গলবিধান (मङ्गलाचार) , যদিও স্পষ্ট বিধি নয়, তথাপি শিষ্টাচার ও কর্মফলাশায় শাস্ত্রসিদ্ধ। “यस्मिन् देशे य आचारः पारम्पर्यक्रमागतः। श्रुतिस्मृत्यविरोधेन सदाचारः स उच्यते॥”

ইতি শ্রীমৎ গঙ্গেশোপাধ্যায়-বিরচিত তত্ত্বচিন্তামণি-গ্রন্থে মঙ্গলবাদসিদ্ধান্ত ( इति श्रीमद्गङ्गेशोपाध्यायविरचिते तत्त्वचिन्तामणौ प्रत्यक्षखण्डे मङ्गलवादः)

পরবর্তী> ज्ञप्तिवादः

প্রতিমা: মহামহোপাধ্যায় বামাচরণ ভট্টাচার্য (১৮৯৯-১৯৫৯)


Leave a Reply