প্রাচীন ভারতের বিচার ও প্রশাসনব্যবস্থা: ধননন্দ থেকে পাল-সেন যুগ পর্যন্ত শৃঙ্খলা ও শাস্তির বিধান
ধননন্দের সময়ে, খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দে ভারতীয় (জম্বুদ্বীপ) বিচারব্যবস্থা তার পূর্ণ রূপে বিদ্যমান ছিল। সে সময় আদালতের ভাষা ছিল সংস্কৃত, আর বিচার রায় ঘোষণার ভাষাও ছিল সংস্কৃত। তবে প্রমাণ উপস্থাপন করা যেত সংস্কৃত কিংবা প্রাকৃত—দুটো ভাষাতেই। বিচারকগণ ছিলেন বহুভাষী, তাঁরা সংস্কৃত, প্রাকৃত ও জনভাষার পাশাপাশি রাষ্ট্রশাসন ও বিচারকার্যের সকল দিক সম্পর্কে সুপণ্ডিত ছিলেন। কেবল ভারতের মানুষই নয়, গ্রিক ও পারস্যদেশীয়রাও উত্তর ভারতের ধর্মাস্থানীয় আদালত থেকে বিচারপ্রক্রিয়ার শিক্ষা নিয়েছিল।
রাজ্যশাসনে কর্মব্যবস্থা ও বিচারব্যবস্থা ছিল কঠোর শৃঙ্খলায় নিয়ন্ত্রিত। রাজসরকারের বাৎসরিক কর্মদিবস নির্ধারিত ছিল ৩৫৪ দিন। আদালতসহ রাজ্যের বিভিন্ন দপ্তরে কর্মরত কর্মচারীরা যদি দ্রব্য আত্মসাৎ করত বা ওজনে কারচুপি করত, তবে প্রথম পর্যায়ে তাদের উপর এক, দুই অথবা চার পণ অর্থদণ্ড ধার্য করা হতো। কিন্তু একই অপরাধ বারবার ঘটালে সাহসদণ্ড আরোপ করা হতো—প্রথমে পূর্ব সাহসদণ্ড আড়াইশো পণ, পরে মধ্যম সাহসদণ্ড পাঁচশো পণ, এবং সবশেষে উত্তম সাহসদণ্ড হাজার পণ। তার পরও যদি অপরাধপ্রবণতা না বদলাত, তবে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হতো। রাজকোষাগারের প্রধান অধীক্ষক যদি কৌশলে অর্থ আত্মসাৎ করত, তবে তার উপর সরাসরি মৃত্যুদণ্ড প্রয়োগ করা হতো। অন্যদিকে অধীনস্থ কর্মচারীরা যদি অর্থ বা দ্রব্য আত্মসাৎ করত, তবে তাদের উপর এমন কঠোর দণ্ড আরোপিত হতো যাতে তারা মৃত্যুবরণ না করলেও অর্ধমৃত অবস্থায় নিপতিত হতো। তবে যদি এই আত্মসাত অধীক্ষকের অগোচরে সংঘটিত হতো, তবে অধীনস্থদের উপর শুধু ভৎসর্না আরোপ করা হতো। কিন্তু কেউ যদি দুঃসাহস প্রদর্শন করে চৌর্যবৃত্তির মাধ্যমে সরাসরি রাজকোষের ধন লুণ্ঠন করত, তবে তার উপর যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হতো।
রাজকোষ ও বিচারপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা বজায় রাখতে হিসাবরক্ষণ ছিল একেবারেই নিখুঁত। হিসাব লিপিবদ্ধ করার জন্য সময়কে বিভাজন করা হতো—একদিন, পাঁচদিন, এক পক্ষ (১৫ দিন), এক মাস, চার মাস এবং পূর্ণ বছর। নিবন্ধনপুস্তকে আয়, ব্যয় ও স্থিতিপত্র পৃথকভাবে নথিভুক্ত থাকত। আয়ের হিসাব রেকর্ড করার সময় বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হতো—বর্ষ, মাস, পক্ষ, দিবস, ঋতুভিত্তিক কাল, আয়ের উৎস, শুল্ক বা সুদ, বকেয়া আয়, মোট আয়ের পরিমাণ, অর্থ প্রদানকারীর নাম, আদায়কারী কর্মচারীর নাম, আয়লিপিকার এবং আয়গ্রহীতার নাম যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে কি না। রাজার আদেশ ভূর্জপত্র ও তালপত্রে লিখিত হতো এবং আচার্যগণ সেই আদেশকে শাসন নামে অভিহিত করতেন।
দ্রব্যের পরিমাপ ও ওজন বিষয়ক দায়িত্বে ছিলেন পৌতবাধ্যক্ষ নামের এক বিশেষ প্রশাসক। তিনি দাঁড়িপাল্লা, বাটখারা এবং অন্যান্য মাপযন্ত্র তৈরি ও মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় কারখানা স্থাপন করাতেন এবং সেখানে মানসম্মত ওজনযন্ত্র নির্মাণ বাধ্যতামূলক ছিল। স্বর্ণের ওজন নির্ধারণের মূল একক ছিল সুবর্ণমাষ, যার মান দশটি ধানের দানা বা পাঁচটি কুঁচ ফলের সমান। ১৬ মাষক মিলে এক কর্ষ, চার কর্ষ সমান এক পল, এবং এই পদ্ধতিতেই স্বর্ণের ওজন করা হতো। রৌপ্যের ওজন নির্ধারণের প্রাথমিক একক ছিল রূপ্যমাষক, যার মান ৮৮টি সাদা সর্ষে দানার সমান। ১৬ রূপ্যমাষক মিলে এক ধরন হতো। স্বর্ণ ও রৌপ্যের ওজন এই নির্ধারিত একক অনুযায়ী মাপা ও বাটখারায় রূপান্তর করা বাধ্যতামূলক ছিল।
এই বিচারপ্রক্রিয়া পাল আমল পর্যন্ত এবং পরবর্তীকালে গৌড়দেশের সেন আমলেও অপরিবর্তিত রয়ে যায়। প্রতিটি বিচার প্রক্রিয়া শুরু হতো পূর্বপক্ষ দিয়ে—অর্থাৎ বাদীর বক্তব্য ও অভিযোগের প্রাথমিক উপস্থাপন। তার পর প্রতিপক্ষের উত্তর ও পাল্টা বক্তব্য শুনে বিচার এগোতো। রায় প্রদান ছিল ন্যায়মুখী এবং সর্বদা শাস্ত্রসম্মত। এর ভিত্তি ছিল—শ্রুতি (বেদ), স্মৃতি (ধর্মশাস্ত্র), সদাচার (দেশজ প্রথা), এবং সবশেষে রাজাজ্ঞা বা রাজার আদেশ। রাজাজ্ঞার স্থান ছিল চতুর্থ, অর্থাৎ রাজা নিজেও ধর্ম, শাস্ত্র ও সমাজপ্রথার সীমার মধ্যে থেকে বিচারকার্যে ভূমিকা রাখতেন।
যদি কেউ ব্রাহ্মণ পরিচয় দাবি করতেন, তবে তাঁকে সর্বোচ্চ মানের বিদ্বজ্জন ও নৈতিকতার পরিচয় দিতে হতো। কেবল জন্ম নয়, ব্রাহ্মণত্বের প্রমাণ ছিল জ্ঞান, আচার, সততা ও ন্যায়নীতির চর্চায়। সেই সময়ের বিচারব্যবস্থা জ্ঞান, ধর্ম, সামাজিক প্রথা ও রাজশাসনের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এক অনন্য প্রতিষ্ঠান ছিল। এর ভিতের উপর দাঁড়িয়ে ভারতীয় ন্যায়চর্চা দীর্ঘকাল অবিকৃতভাবে চলেছে এবং পাল ও সেন যুগ পর্যন্ত তার ধারাবাহিকতা বজায় থেকেছে।
কৌটিল্য বিষ্ণুগুপ্তের যুগে ভারতীয় (জম্বুদ্বীপ) বিচারব্যবস্থা এক গভীর ও সুসংগঠিত রূপ লাভ করেছিল। তাঁর অর্থশাস্ত্র শুধু রাষ্ট্রনীতি নয়, বিচারব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে আলোকপাত করেছে। সেই সময় বিচারকে বলা হতো ধর্মস্থীয়, অর্থাৎ ধর্মনীতি ও রাজনীতির সমন্বয়ে গঠিত এক মহৎ প্রতিষ্ঠান, আদালতকে ধর্মনিকায়ে বলা হত। বিচার কার্য সম্পাদনের দায়িত্ব পালন করতেন যথাযথ গুণসম্পন্ন, পরীক্ষিত ও প্রশিক্ষিত অমাত্যগণ। তিনজন বিচারক এবং তিনজন অমাত্যের সমন্বয়ে একটি বিচারকমণ্ডলী গঠিত হতো, যারা দুই জনপদের সঙ্গমস্থলে, অন্তঃপাল দুর্গে, দশটি গ্রামের কেন্দ্রস্থলে (সংগ্ৰহণ), চারশো গ্রামের কেন্দ্রস্থলে (দ্রোণমুখ), এবং আটশো গ্রামের কেন্দ্রস্থলে (স্থানীয়) আদালত (ধর্মনিকায়)বসিয়ে দেওয়ানি মামলা যেমন অর্থদান বা ঋণগ্রহণ সম্পর্কিত বিবাদ মীমাংসা করতেন।
বিচারকার্যের সময় বাদী ও বিবাদীর বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শোনা হতো। যে সব চুক্তি অস্পষ্ট, গৃহাভ্যন্তরে অন্যের অগোচরে সম্পাদিত, রাত্রিকালে বা অরণ্যের নির্জনতায় গোপনে সম্পাদিত, ছলনা বা প্রতারণার মাধ্যমে সাক্ষীহীনভাবে সম্পাদিত হতো—সেগুলো বাতিল বলে গণ্য করা হতো। যারা ইচ্ছাকৃতভাবে এমন চুক্তি করত, তাদের উপর শাস্তি বা দণ্ড আরোপ করা হতো। তবে অসচেতনভাবে সজ্জন কেউ এরূপ চুক্তিতে জড়িয়ে পড়লে তাঁকে অপরাধী ধরা হতো না, কেবল তাঁর আর্থিক ক্ষতির দায়ভার তিনিই বহন করতেন।
স্থাবর সম্পত্তি বন্ধক রেখে ঋণ গ্রহণ তৎকালীন সমাজে নিন্দনীয় হলেও, যদি তা লোকসমাজে গৃহীত হয় তবে বৈধ বলে গণ্য করা হতো। আবার যারা অসুস্থতার কারণে গৃহ থেকে বের হতে অক্ষম কিংবা নারী যারা গৃহাভ্যন্তরে সীমাবদ্ধ, তাঁদের দ্বারা সম্পাদিত গৃহাভ্যন্তরের চুক্তিও বৈধ হিসেবে ধরা হতো। অপরদিকে বলপূর্বক লুণ্ঠন, বিবাহ, রাজাজ্ঞা প্রতিপালন, মদ্যপ বা রূপাজীবীদের সঙ্গে সম্পর্কিত চুক্তি রাত্রিকালে সম্পাদিত হলেও অবৈধ নয়, বরং বৈধ হিসেবে গৃহীত হতো। অরণ্যে সম্পাদিত চুক্তি সাধারণভাবে অবৈধ হলেও, বণিক সংঘ, গো-রক্ষক, আশ্রমবাসী, গুপ্তচর বা অরণ্যবাসীদের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি বৈধ বলে স্বীকৃত হতো। গুপ্তচর বৃত্তির স্বার্থে প্রতারণামূলক চুক্তিও বৈধ বলে গৃহীত হতো। একইভাবে গান্ধর্ব বিবাহ সাক্ষীবিহীনভাবে গোপনে সম্পাদিত হলেও তা বৈধতা পেত।
অন্যদিকে যারা পিতা-পুত্র, ভ্রাতা, স্ত্রী, দাস, অপ্রাপ্তবয়স্ক, অতিবৃদ্ধ, সাজাপ্রাপ্ত, সন্ন্যাসী, মূক-বধির, নারীর দোষে দুষ্ট, জুয়াড়ি বা নেশাগ্রস্ত—তাঁদের দ্বারা সম্পাদিত কোনো চুক্তি বৈধ বলে গণ্য হতো না। তবে রাজা যদি অনুমোদন দিতেন, সেই চুক্তি বৈধতা লাভ করত। ক্রোধ, দুঃখ, নেশা বা অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় সম্পাদিত চুক্তিও অবৈধ হতো।
বাদী মামলা দায়ের করলে বিচারক বাদী-বিবাদীর নাম, জাতি, গোত্র, দেশ, গ্রাম, পেশা এবং ঋণের পরিমাণ ও সময় লিপিবদ্ধ করতেন। অভিযোগ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করা হতো। অভিযোগকারী যদি বিষয়ে বিচ্যুত হন, আগের বক্তব্য পরিবর্তন করেন, প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হন, মিথ্যা সাক্ষী হাজির করেন, সাক্ষী পরিবর্তন করেন বা সাক্ষীর সঙ্গে গোপন শলা-পরামর্শ করেন, তবে তাঁর অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হতো না। এর ফলে মামলায় হেরে গেলে বাদীকে প্রদেয় অর্থের সঙ্গে অতিরিক্ত জরিমানা দিতে হতো। সাক্ষী ছাড়া নিজের মামলা লড়তে গিয়ে পরাজিত হলে দশগুণ জরিমানা ধার্য হতো।
অভিযুক্ত ব্যক্তি অভিযোগের উত্তর সঙ্গে সঙ্গে দিতে ব্যর্থ হলে তিন থেকে সাত দিন সময় দেওয়া হতো, তাতেও ব্যর্থ হলে জরিমানা ধার্য করা হতো। ৪৫ দিনের মধ্যেও উত্তর না দিলে অতিরিক্ত জরিমানা আরোপ করা হতো এবং প্রয়োজনে অভিযুক্তকে বাদীর ক্ষতিপূরণস্বরূপ ধান, সোনা, গহনা বা অন্য দ্রব্য দিতে হতো। ঋণ শোধে অক্ষম হলে কায়িক শ্রম দিয়ে ক্ষতিপূরণ শোধ করতে হতো, তবে ব্রাহ্মণের ক্ষেত্রে এ নিয়ম কার্যকর করা যেত না।
বিচারকার্যের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ধর্ম ও সমাজশৃঙ্খলা রক্ষা। প্রতিটি বিবাদের সঙ্গে যুক্ত থাকত ধর্মের বিধান, শাস্ত্র, দেশজ প্রথা ও রাজানুশাসন। এর মধ্যে রাজানুশাসনই ছিল চূড়ান্ত, কিন্তু সেটির ভিত্তি ছিল ধর্ম, ব্যবহার, চরিত্র ও লোকাচার। যে রাজা ধর্মশাস্ত্র অনুযায়ী ন্যায়বিচার করতেন, প্রজাদের রক্ষা করতেন, তাঁকে স্বর্গগমনযোগ্য ধরা হতো। আর যে রাজা প্রজা-পীড়ন করতেন, তাঁকে নরকে পতিত হওয়ার উপযুক্ত বলা হতো।
ন্যায়সঙ্গত বিচার ও নিরপেক্ষ শাস্তি প্রদান রাজাকে কেবল এ পৃথিবীতে নয়, পরজীবনেও সুরক্ষিত রাখত। রাজা যদি নিজের পুত্র ও শত্রুর বিরুদ্ধে একইভাবে শাস্তি আরোপ করতে পারতেন, তবে তাঁর শাসন সত্যিকার অর্থে ধর্মময় বলে গণ্য হতো। আইন ও শাস্ত্রের দ্বন্দ্ব দেখা দিলে ধর্মশাস্ত্র অনুসরণীয় হলেও, ধর্মশাস্ত্র ও ন্যায়শাস্ত্র পরস্পর সাংঘর্ষিক হলে ন্যায়শাস্ত্রকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হতো। প্রমাণ, স্বীকারোক্তি, যুক্তিসঙ্গত জবাব, সাক্ষ্য ও শপথের মাধ্যমে বিচার নিষ্পত্তি ঘটত। বাদী বা বিবাদী কেউ অসামঞ্জস্যপূর্ণ বক্তব্য দিলে, অসার সাক্ষী হাজির করলে বা শাস্তি এড়াতে পালিয়ে গেলে, তাঁকে অপরাধী হিসেবে গণ্য করা হতো।
সোমবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
Read also