নারদ কর্তৃক প্রণীত শিবানুশাসন “নারদভক্তিসূত্র”-এর বাংলা অনুবাদ

নারদ কর্তৃক প্রণীত শিবানুশাসন “নারদভক্তিসূত্র”-এর বাংলা অনুবাদ

নারদ ভক্তিসূত্র: রাধা-পরকীয়া প্রেম ও গৌড়ীয় রসসাধনার বাহিরে এক শুদ্ধ ভক্তিতত্ত্ব

নারদ ভক্তিসূত্র একটি সংক্ষিপ্ত অথচ গভীর দর্শনসমৃদ্ধ গ্রন্থ, যার মাধ্যমে একজন জ্ঞানী গ্রন্থকর্তা ভক্তির প্রকৃত স্বরূপ এবং তার পথের শ্রেষ্ঠতা ব্যাখ্যা করেছেন। এই গ্রন্থে মোট ৮৪টি সূত্র আছে। প্রথম ২৪টি সূত্রে ভক্তির স্বরূপ, তার গঠন, অভিজ্ঞান এবং অন্বয়ের কথা বলা হয়েছে। পরবর্তী ৯টি সূত্র (২৫-৩৩) ব্যাখ্যা করে কেন ভক্তির পথ কর্ম, জ্ঞান ও যোগ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও অনন্য। সূত্র ৩৪ থেকে ৫০ অবধি মোট ১৭টি সূত্রে বর্ণিত হয়েছে কিভাবে ভক্তি চর্চা করা যায় এবং ধীরে ধীরে তা বিকাশ লাভ করে।

৫১ থেকে ৬৬ নম্বর সূত্র পর্যন্ত ১৬টি সূত্রে ভক্তের মধ্যে দৃশ্যমান ভক্তির বহির্গত লক্ষণাবলী ব্যাখ্যা করা হয়েছে—যেমন তার ব্যবহার, অভিব্যক্তি, চেতনার রূপান্তর ইত্যাদি। সর্বশেষ ১৮টি সূত্র (৬৭-৮৪) উত্সর্গ করা হয়েছে সেই মহাপ্রেমাবিষ্ট সিদ্ধ ভক্তদের মহিমা বর্ণনার জন্য, যাঁরা কৃষ্ণভক্তিতে পূর্ণ।

নারদ এই সূত্রসমূহে কখনও কৃষ্ণের নাম উচ্চারণ করেননি, কিন্তু বৃন্দাবনের গোপীদের উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে প্রকৃত ঈশ্বরভক্তি কেমন হওয়া উচিত। সম্ভবত এই ঈশ্বর ছিলেন বিষ্ণু, যাঁর কথা শ্বেতাশ্বেতর উপনিষদে উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে গাভীরা বহু শৃঙ্গযুক্ত, সেই স্থানেই ভগবানের পরমপদ প্রকাশিত হয় (ঋগ্বেদে ১.১৫৪.৬) ।  গোপীরা ঈশ্বরকে কামনা করত, প্রেম করত, তাঁর বিচ্ছেদে কাঁদত—এই নিবেদন, এই আকুলতা ভক্তির মূল ছায়া হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু গ্রন্থকার এখানে রাধার নামও উল্লেখ করেননি, রসবিলাস কিংবা রাসলীলারও কোনো ইঙ্গিত দেননি। যে ‘রাধা’ পরবর্তীকালে সাহিত্য ও বৈষ্ণব কাব্যে এসেছে, তা এই সূত্রকারের জগতে অনুপস্থিত। গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের ‘মহাভাব’ ও চৈতন্য গোবিন্দভক্তির ধারা—যেখানে প্রেম একটি রসসিদ্ধ ভক্তিরূপে গীত হয়েছে—তা নারদীয় ভক্তিসূত্রে নেই। চণ্ডীদাসের রাধাকে সেন রাজবংশের (একাদশ এবং দ্বাদশ শতাব্দী) সভাকবিরা আবিষ্কার করেছিলেন।

নারদ ভক্তিসূত্রের ভাবধারায় তথাকথিত ‘রাধা’ ও ‘পরকীয়া প্রেম’-এর কোনো স্থান নেই। এই প্রেম-রস, যা পরবর্তীকালে বৈষ্ণব পদাবলিতে ও গৌড়ীয় সাধনায় কেন্দ্রীয় হয়ে ওঠে, তা নারদীয় সূত্রে অনুপস্থিত। গোপীদের উদাহরণ দেওয়া হলেও সেখানে কাব্যিক রসোপলব্ধি বা লীলার কল্পনার কোনো ইঙ্গিত নেই—কেবল নিঃস্বার্থ আত্মনিবেদন ও ঈশ্বর-বিস্মৃতিতে চরম উদ্বেগ, এইটিই ভক্তির পরাকাষ্ঠা বলে চিহ্নিত হয়েছে।

আবার এই ভক্তিসূত্রটি বোপদেবের ভগবদ পুরাণ এবং মধ্যাচার্যের আগে (১৩১৭ সালে উদুপিতে মৃত্যুবরণ করেন)স্বাধীনভাবে বিকশিত হয়েছিল। আমরা বলতে পারি যে কর্ণাটক থেকে চৈতন্য মহাপ্রভুর আনা ব্রহ্মসংহিতার সাথেও এই ভক্তিসূত্রের কোনও সম্পর্ক নেই। ব্রহ্মসংহিতায় কৃষ্ণের উল্লেখ খুব স্পষ্টভাবে করা হয়েছে। সেখানে তাঁর জপমন্ত্রের উল্লেখ রয়েছে। ক্লিম কৃষ্ণায় গোপীজনবল্লভায় ইত্যাদি। শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন একজন বৈদিক রাজা, তিনি কখনও কোনও মহিলার সাথে মেলামেশা করতেন না যদি না তিনি তাঁর বিবাহিত স্ত্রী হন। তিনি সর্বদা তাঁর স্ত্রী রুখ্মিণী এবং সত্যভামার সাথে উপস্থিত থাকতেন।

গৌড়ীয় ভক্তির ধারায় চৈতন্য মহাপ্রভুর ‘মহাভাব’, তাঁর উন্মত্ত প্রেমময় কৃষ্ণলীলার আস্বাদ—এই রসসাধনা নারদীয় ভক্তিসূত্রে প্রতিফলিত হয় না। সেই রসমূলক উপস্থাপনা, যেখানে রাধা কৃষ্ণের প্রেমে শারীরিকভাবে অধিকারী, একেবারেই একটি পরবর্তী সাহিত্যিক নির্মাণ।

জয়দেব, বিদ্যাপতি এবং চণ্ডীদাস তাঁদের কাব্যে যেভাবে নারীশরীরকে যৌনরসের মাধ্যমে ‘ভক্তি’রূপে উপস্থাপন করেছেন, তা নারদীয় ভক্তির সাধনার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ নয়। তাঁদের রাধা হলেন একটি কল্পিত নায়িকা, যিনি শারীরিক মিলনের দ্বারা কৃষ্ণের তৃপ্তি বিধান কারেন। জয়দেবের কৃষ্ণের রাধার সাথে চালাকি করে যৌন সম্পর্ক, বিদ্যাপতি এবং চণ্ডীদাসের জৈব সংবেদনশীলতা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত নারদে। অথচ ভাগবত পুরাণ (বোপদেব দ্বারা) স্পষ্ট করে বলেছে, কৃষ্ণ অষ্টবছর বয়সে বৃন্দাবন ত্যাগ করেন এবং পুনরায় সেখানে ফিরে আসেননি। মহাভারতের কৃষ্ণ, যিনি একজন ক্ষত্রিয় রাজা এবং আজীবন রাজধর্ম ও শাসননীতি অনুসরণ করেছেন।

জয়দেব, বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস তাঁদের কাব্যে যে প্রেমের কথা বলেছিলেন, তা মূলত কাব্যরসের জন্য, যেখানে নারীশরীর, আকাঙ্ক্ষা ও কামনার অনুষঙ্গে ঈশ্বরতত্ত্বকে যুক্ত করা হয়েছে। এদের লক্ষ্য ছিল না সিদ্ধ ভক্তির সাধনা, বরং একটি সাহিত্যিক ভাষ্যে প্রেমিক-প্রেমিকার মিলনের মাধ্যমে কবিতার রস সৃষ্টি। তাঁদের রাধা কল্পিত এক নায়িকা, যিনি কৃষ্ণের সঙ্গে লুকিয়ে লুকিয়ে শারীরিক মিলনে লিপ্ত হন। ভক্তিসূত্রের রচয়িতা এই রাধা-চেতনার সঙ্গে সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিলেন। তিনি যে কৃষ্ণের নাম পর্যন্ত উল্লেখ করেননি, তাতে বোঝা যায় যে, তাঁর দৃষ্টিতে ভক্তি ব্যক্তির অভ্যন্তরে ঘটিত এক গভীর রূপান্তর, যেখানে ঈশ্বর কোনও রসভরা নায়ক নন, বরং এক শাশ্বত আশ্রয়।

গীতা-র কৃষ্ণের ভক্তি একটি নিয়মশৃঙ্খলাভিত্তিক আত্মনিবেদন, যেখানে ঈশ্বরপ্রেম একটি আত্মবিসর্জনের নিয়ম। এখানে কোন প্রেম-লীলা নেই, কোন রসিকতা নেই—আছে কর্তব্য, কর্তব্য এবং কর্তব্য।

নারদ যে এই গ্রন্থের রচয়িতা—তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। কৌটিল্য বা বিষ্ণুগুপ্ত (৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) যে নারদের কথা উল্লেখ করেছেন, তিনি ছিলেন এক বিশাল প্রশাসনিক ও বৈদিক শাস্ত্র বিশারদ। পরবর্তী যুগে বহু লেখক নারদের নামে এই ধরনের দর্শন রচনা করেছেন। এই গ্রন্থের শেষে বলা হয়েছে, এই ভক্তিসূত্র আদিতে শিবের মুখনিঃসৃত, নারদ কেবল সেটিকে পরিবেশন করেছেন। অনুমান করা চলে, এই গ্রন্থ ১১০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে দক্ষিণ ভারতে রচিত হয়েছিল।

এই সময়েই শাণ্ডিল্য ভক্তিসূত্রও রচিত হয়, যার ভাষা ও ভাবনার সঙ্গে নারদীয় সূত্রের মিল পাওয়া যায়। উভয় সূত্রের মূল লক্ষ্য মানবজীবনের পূর্ণতা সাধন ও আত্মসিদ্ধি। বেদীয় শাস্ত্রের মর্ম এই যে, একটি সুসংবদ্ধ রাষ্ট্রের কাঠামোর ভিতরে থেকে ব্যক্তি যখন কর্ম, ধর্ম ও জ্ঞানের সাধনার দ্বারা পরিপূর্ণ হয়, তখনই সে উপনিষদের মত অন্তর্দর্শন ও আত্মজিজ্ঞাসার উপযুক্ত হয়।

ব্রহ্মসূত্রে ইঙ্গিত করা হয়েছে—”একটি সত্য প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে বহু বছর লাগে।” এবং ভক্তি শব্দটি “ভক্‌” ধাতুতে “তিন্‌” প্রত্যয় যুক্ত হয়ে সৃষ্টি হয়েছে, যার ব্যাকরণগত অর্থ—”পরিপক্ক হয়ে ওঠা”। সুতরাং ভক্তি একটি বিকাশ, একটি পূর্ণতা, যা ধীরে ধীরে মানুষকে আত্মানুসন্ধানের পথে নিয়ে যায়।

এমন কথাও বলা হয় যে—নারদ আজও জীবিত, কোথাও সপ্তঋষিদের সঙ্গে অবস্থান করছেন, এই সনাতন ধর্ম ও মানবসভ্যতার ধারক হিসেবে। সনাতন এই ধারারই প্রাণ, নারদ সেই ধারারই প্রতীক, আর এই শিবানুশাসন সেই চিরন্তন ধ্যান ও সাধনার প্রতিধ্বনি।


নারদভক্তিসূত্র (মূল সংস্কৃত পাঠের অনুবাদ)

এখন আমি ভক্তি ব্যাখ্যা করব ।

ভক্তি এই পরম প্রেমের রূপ

এটি অমৃতের স্বরূপ

যে ব্যক্তি এই ভক্তিকে লাভ করে, সে সিদ্ধ হয়, অমর হয়, তৃপ্ত হয়।

যে এটিকে লাভ করে, সে আর কিছু চায় না, দুঃখ পায় না, বিরক্ত হয় না, কিছুর প্রতি আসক্ত হয় না, উৎসাহহীন হয় না।

যে এটিকে জানে, সে উন্মত্ত হয়, অবিচল হয়, নিজের মধ্যেই আত্মারাম হয়ে যায়।

ভক্তি কোন কামনার আকর্ষণে প্রণোদিত হয় না, কারণ এটি নিয়ন্ত্রণের (निरोधरूपत्वात्) স্বরূপ।

এই নিয়ন্ত্রণ (निरोधरूपत्वात्) মানে জাগতিক ও বৈদিক ক্রিয়াকলাপের পরিত্যাগ।

এই ভক্তিতে একাগ্রতা, ও এর বিরোধীদের প্রতি নিরাসক্ততা থাকা প্রয়োজন।

অন্য আশ্রয় ত্যাগ করাই একাগ্রতা।

জাগতিক ও বৈদিক আচরণেও যা ঈশ্বরের অনুকূল, তা গ্রহণযোগ্য, আর যা বিরোধী, তার প্রতি নিরাসক্ত থাকা উচিত।

একবার নিশ্চিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে, শাস্ত্রের রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে।

অন্যথায় পতনের আশঙ্কা থাকে।

জীবনধারণ পর্যন্ত লোকের কার্যকলাপ, যেমন ভোজন ইত্যাদি, এই পর্যন্তই সীমাবদ্ধ।

এই ভক্তির লক্ষণসমূহ ব্যাখ্যা করা হবে বিভিন্ন মতভেদ অনুসারে।

পরাশর বলেন, পূজার প্রতি অনুরাগই ভক্তি।

গর্গ বলেন, কীর্তন-কথা শ্রবণের মধ্যে ভক্তি।

শাণ্ডিল্য বলেন, আত্মারামের বিরোধ না হলে তা ভক্তি।

নারদ বলেন, সমস্ত আচরণ ভগবানকে অর্পণ করা, এবং তাঁকে ভুলে গেলে চরম ব্যাকুলতা হওয়াই ভক্তি।

এমনই সত্য।

যেমন বৃন্দাবনের গোপীগণ।

তবু, তাদের ভক্তি মহিমাজ্ঞানের বিস্মৃতিবশত নয়।

ভগবৎভক্তিবিহীন প্রেম পতিতদের মতো।

সেই প্রেমে ঈশ্বরের আনন্দে আত্মতৃপ্তি নেই।

এই ভক্তি কর্ম, জ্ঞান, ও যোগ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ।

কারণ এটি ফলের রূপ।

ঈশ্বরও গর্ব-দ্বেষ পছন্দ করেন না, বিনয় তাঁকে প্রিয়

কিছু জন বলেন, জ্ঞানই এর একমাত্র উপায়।

অন্যরা বলেন, এটি পারস্পরিক নির্ভরতার বিষয়।

ব্রহ্মকুমার বলেন, এটি নিজেই ফলরূপ।

যেমন রাজবাড়ির ভোজনেও দেখা যায়।

তবু রাজা এতে সন্তুষ্ট হন না, কেবল ক্ষুধা নিবারিত হয়।

অতএব মুক্তিচাইতে হলে এই ভক্তিই গ্রহণীয়।

এই ভক্তির উপায়গুলি আচার্যগণ বলেন।

তা হল ইন্দ্রিয়সুখ ও সঙ্গ ত্যাগ।

নিরবিচারে ভগবৎস্মরণ ও ভজন।

জগতে ভগবানের গুণ শ্রবণ ও কীর্তন।

তবু প্রধানত মহাপুরুষের অনুগ্রহ বা ভগবানের কৃপা দ্বারাই (महत्कृपयैव भगवत्कृपालेशाद्वा)।

মহাপুরুষসঙ্গ দুর্লভ, দুর্বোধ্য এবং অমোঘ।

তবু তাঁর কৃপায় তা লাভ হয়।

কারণ সেই ভক্তজনের মধ্যেই ঈশ্বর বিদ্যমান।

সেই লক্ষ্যই সাধন হওয়া উচিত, সেটিই চরম উদ্দেশ্য।

অসৎসঙ্গ সম্পূর্ণভাবে ত্যাজ্য।

কারণ তা কাম, ক্রোধ, মোহ, স্মৃতি বিনাশ, বুদ্ধি নাশ ও সর্বনাশ ডেকে আনে।

প্রথমে এরা ক্ষুদ্র ঢেউয়ের মতো হলেও, শেষে মহাসমুদ্রের মতো হয়ে ওঠে।

কে পার হয়, কে পার হয় মায়া? সে-ই পারে, যে সঙ্গ ত্যাগ করে, মহাপুরুষের সেবা করে, নির্মম হয়।

যে নির্জন স্থান গ্রহণ করে, সংসার-বন্ধন ছিন্ন করে, গুণাতীত হয়, যে ভরণপোষণের চিন্তা ত্যাগ করে।

যে কর্মফল ত্যাগ করে, কর্ম পরিত্যাগ করে, তখন দ্বন্দ্বশূন্য হয়।

যে বেদও ত্যাগ করে, সে ভগবানে নিরবিচ্ছিন্ন প্রেমলাভ করে।

সে পার হয়, সে পার হয়, অন্যদেরও পার করায়।

প্রেম বর্ণনাতীত (अनिर्वचनीयं प्रेमस्वरूपम्)

যেন বোবা ব্যক্তি মধুর স্বাদ পায়।

এটি কোনো যোগ্য পাত্রে আত্মপ্রকাশ করে।

এটি গুণহীন, কামনাহীন, প্রতিক্ষণে বাড়ে, নিরবিচ্ছিন্ন, অতিসূক্ষ্ম, ও অভিজ্ঞতার বিষয়।

যে এটি লাভ করে, সে তাকেই দেখে, তাকেই শোনে, তাকেই বলে, তাকেই চিন্তা করে।

গৌণ ভক্তি তিন প্রকার—গুণভেদ, আর্ততা ইত্যাদি অনুযায়ী।

পরবর্তীটি আগের চেয়ে শ্রেয়স্কর।

ভক্তি অন্য পথের চেয়ে সহজলভ্য।

কারণ তা অন্য প্রমাণের উপর নির্ভর করে না, নিজেই প্রমাণ।

কারণ তা শান্তি ও পরমানন্দের স্বরূপ।

জগতে ক্ষতির চিন্তা না করাই শ্রেয়, আত্মনিবেদনের ফলে লোক ও বেদ দুইই ঈশ্বরকে নিবেদিত।

সেই সিদ্ধিতে জগৎ পরিত্যাজ্য নয়, বরং ফলত্যাগ ও তার উপায় অবশ্য পালনীয়।

নারী, ধন, নাস্তিকতা ও শত্রুর চরিত্র শ্রবণীয় নয়।

গর্ব, অহঙ্কার ইত্যাদি ত্যাগযোগ্য।

সমস্ত আচরণ ঈশ্বরকে অর্পণ করে কাম, ক্রোধ, অহঙ্কার ইত্যাদি তাঁর জন্যেই ব্যবহার করতে হবে।

ভক্তি প্রেমের রূপে হওয়া উচিত—নিত্য দাস্য, নিত্য প্রেয়সীভাব, প্রেমই উদ্দেশ্য, প্রেমই কর্ম।

একান্তভক্তরাই প্রধান।

তারা কণ্ঠরোধ, রোমাঞ্চ, অশ্রুভরে পরস্পর কথা বলেন, কুল ও পৃথিবীকে পবিত্র করেন।

তারা তীর্থকে তীর্থ করেন (तीर्थीकुर्वन्ति तीर्थानि), কর্মকে সুকর্ম করেন, শাস্ত্রকে সত্য শাস্ত্রে পরিণত করেন।

তারা ভগবানে আত্মস্থ (तन्मयाः)।

তাদের পিতৃগণ আনন্দে মেতে ওঠেন, দেবতাগণ নৃত্য করেন, ও পৃথিবী ঈশ্বরের আশ্রিত হয়।

তাদের মধ্যে জাতি, বিদ্যা, রূপ, বংশ, ধন, কর্ম—কোনো ভেদ নেই।

কারণ তারা ভগবানের।

তর্ক অবলম্বনযোগ্য নয় (वादो नावलम्ब्यः)।

কারণ এতে অতিরিক্ততা ও অনির্ধারিততা থাকে।

ভক্তিশাস্ত্র স্মরণীয়, ও সেগুলির নির্দেশিত কর্ম পালনীয়।

সুখ, দুঃখ, ইচ্ছা, লাভ ইত্যাদি ত্যাগ করে, অপেক্ষার সময়টুকুও নষ্ট করা উচিত নয়।

অহিংসা, সত্য, শৌচ, দয়া, আস্তিকতা ইত্যাদি চরিত্র গুণ রক্ষা করা উচিত।

সর্বদা, সমস্ত মনোযোগে ও নিশ্চিন্ত চিত্তে কেবল ভগবানকেই ভজনা উচিত।

তাঁকে কীর্তন করলে তিনি তৎক্ষণাৎ আবির্ভূত হন (शीघ्रमेवाविर्भवत्यनुभावयति) এবং ভক্তকে অনুভব করান।

তিন সত্যের মধ্যে ভক্তিই সর্বোচ্চ, ভক্তিই সর্বোত্তম।

ভক্তি এক হলেও তা গুণমহিমা-আসক্তি, রূপাসক্তি, পূজাসক্তি, স্মরণাসক্তি, দাস্যাসক্তি, সখ্যাসক্তি, ব্যাতসাল্যাসক্তি, কান্তাসক্তি, আত্মনিবেদনাসক্তি, আত্মস্থতা, চরম বিরহাসক্তি—এইরূপ একাদশ ভাগে বিভক্ত

এমনটাই বলেন—যারা জনমতের ভয় করেন না, একমতে অটল—কুমার, ব্যাস, শুক, শাণ্ডিল্য, গর্গ, বিষ্ণু, কাউণ্ডিল্য, চৈষ, উদ্ধব, অরুণি, বলি, হনুমান, বিভীষণ প্রভৃতি ভক্ত আচার্যগণ

যে ব্যক্তি নারদ কর্তৃক প্রণীত এই শিবানুশাসনকে বিশ্বাস করে ও শ্রদ্ধা করে, সে ভক্ত হয়, সে প্রিয়তম লাভ করে—সে প্রিয়তম লাভ করে।

“মন্দিরে কৃষ্ণ মূর্তির পাশাপাশি রাধা (राधा) মূর্তি স্থাপন কৃষ্ণ উপাসনার বিকাশের একটি আকর্ষণীয় দিক। মনে হয় ১৭০০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে কৃষ্ণের সাথে রাধার শারীরিক প্রতিচ্ছবি প্রাধান্য পেতে শুরু করে। আওরঙ্গজেব যখন বৃন্দাবন এবং মথুরা আক্রমণ করেন, তখন কৃষ্ণের সাথে কোনও রাধা মূর্তি ছিল না”। Read More


ভক্তি সূত্রের বিষয়বস্তু

ভগবানের প্রতি একান্ত প্রেমই ভক্তি—এই প্রেম কেবলমাত্র হৃদয়ে অনুভব করা যায়, ভাষায় ব্যাখ্যা করা যায় না। প্রাচীন তপস্বী মহর্ষি নারদ যখন মহাদেব শঙ্করের কাছে ভক্তির প্রকৃত স্বরূপ জানতে চাইলেন, তখন শিব যা বলেছিলেন, তা ছিল না কেবল একটি দার্শনিক অনুশাসন—তা ছিল প্রেমের মধ্য দিয়ে পরম সত্যের স্পর্শ। সেই নির্দেশ, সেই অপূর্ব উপদেশ আমাদের হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছায়, যদি আমরা শ্রদ্ধা দিয়ে তা শ্রবণ করি।

ভক্তি একটি এমন আত্মিক অবস্থা, যেখানে ইন্দ্রিয়ের মোহ, বুদ্ধির অহঙ্কার, কর্মের গর্ব, কিংবা জ্ঞানের বুদ্ধিমত্তা—সব কিছু আপনিই গলে যায় এক অপার শান্তির মধ্যে। শিব বলেছিলেন, ভক্তি অমৃত। অর্থাৎ, যে ভক্তিকে পায়, সে আর মৃত্যু চিনে না, চায় না কিছু, হর্ষে বা শোকে স্পর্শ পায় না, ভগবানের দর্শন, শ্রবণ, কীর্তনেই জীবন মিশে যায়।

এই ভক্তি কামনার উপরে , মোহ বা লাভের উপর —এ এক নিঃশর্ত প্রেম। এই প্রেম এমন যে, ইচ্ছা ও অশান্তি সেখানে প্রবেশ করতে পারে না। যেখানে এই ভক্তি আছে, সেখানে ইন্দ্রিয় সুখের আকর্ষণ, বা জগতের ভেদাভেদ সমস্ত মুছে যায়। এই ভক্তিকে যারা পেয়েছেন, তারা বৃন্দাবনের সেই গোপীগণের মতো, যারা ঈশ্বরের মহিমা ভুলে তাঁর লীলায় আত্মবিস্মৃত হয়েছেন, প্রেমে উন্মাদ হয়েছেন।

যার মধ্যে আছেন পরাশর, গর্গ, শাণ্ডিল্য, নারদ প্রমুখ ঋষিরা। ভক্তদের কেউ বলেন পূজাই ভক্তি, কেউ বলেন কথাশ্রবণ, কেউ বলেন আত্মারামের সঙ্গে অদ্বৈততা—কিন্তু নারদ বললেন, ভগবানকে অর্পিত আচরণ, ও তাঁকে ভুলে গেলে চরম ব্যাকুলতা—এই প্রেমই ভক্তি। এ যেন এমন প্রেম, যেখানে ভুলে যাওয়া মানেই যন্ত্রণা, বিচ্ছেদ মানেই মৃত্যু, আর স্মরণ মানেই পরম শান্তি।

এই ভক্তি যোগ, কর্ম, জ্ঞান—সবকিছুর ঊর্ধ্বে। ঈশ্বরও এমন প্রেম ভালোবাসেন, যা অহঙ্কারমুক্ত, দীনতা ও সরলতায় পরিপূর্ণ। এই ভক্তির ফল পেতে হলে প্রয়োজন ইন্দ্রিয়ের নিয়ন্ত্রণ, সৎসঙ্গ, ও নিরবিচারে ভগবৎচিন্তন। কিন্তু সব কিছুর উপরে যে জিনিসটি দরকার, তা হল—একজন মহানুভবের কৃপা। কারণ ঈশ্বরের অনুগ্রহ মূলত ভক্তদের মধ্যে দিয়েই আসে।

শিব বলেছিলেন—কে পারে এই মায়া পার হতে? সে-ই পারে, যে দম্ভ ত্যাগ করে, কাম-ক্রোধের বন্ধন ছিন্ন করে, নির্জনতা গ্রহণ করে, সংসারকে পিছনে ফেলে ভগবানের প্রেমে ডুবে যায়। এই প্রেম ব্যাখ্যার অতীত। এটি বোবার মধুর স্বাদের মতো—অনুভবে আছে, কথায় ধরা যায় না।

এই প্রেমই জীবনের লক্ষ্য। এই প্রেমই একমাত্র ধন, যা সব জাতি, বিদ্যা, বংশ, রূপ, ধন ইত্যাদির উর্ধ্বে। ভক্তদের মধ্যে কোনও ভেদ নেই। তাদের কান্না, হাসি, কণ্ঠরোধ, রোমাঞ্চ—এই সবকিছুতেই ঈশ্বর প্রকাশিত হন। তাদের চোখের জলে, কথার ভাঁজে, স্তবের ধ্বনিতে আমাদের হৃদয় চুপ করে যায়। তাদের মাধ্যমে পৃথিবী পবিত্র হয়, তীর্থ হয়, কর্ম হয় পুণ্য, শাস্ত্র হয় সত্য।

এই প্রেম কোনও কল্পনা নয়। এটি সেই সত্য, যা নিজের মধ্যেই প্রমাণ, শান্তি, ও পরমানন্দ। যেখানে এই প্রেম নেই, সেখানে সমস্ত জ্ঞানই শুষ্ক, সমস্ত সাধনই অর্থহীন। কিন্তু এই প্রেম যাঁর হৃদয়ে ফুটে ওঠে, তিনি শুধু নিজেই পার হন না, অন্যকেও পার করিয়ে নিয়ে যান।

এই প্রেম—ভক্তি—শিবের কণ্ঠ থেকে নারদের হৃদয়ে প্রবাহিত হয়েছিল। আজও সেই প্রবাহ বহমান।


Leave a Reply