ঐতরেয় আরণ্যক (প্রথম আরণ্যক)

ঐতরেয় আরণ্যক

ঐতরেয় আরণ্যক

আরণ্যক 1, আরণ্যক 2, আরণ্যক 3, আরণ্যক 4, আরণ্যক 5

বাহ্বৃচ ব্রাহ্মণারণ্যকের প্রথম আরণ্যক

(ভূমি স্পর্শ ও মন্ত্রোচ্চারণ)

আগুনের উদ্দেশ্যে ভূমি স্পর্শ করে উচ্চারণ করিবে— “ইলা নমঃ। ইলা নমঃ। ঋষিদের, মন্ত্র রচয়িতাদের, মন্ত্র পরিচালনাকারীদের উদ্দেশ্যে নমস্কার। দেবতাদের প্রতি নমস্কার। হে দেবী সরস্বতী, তুমি আমাদের কল্যাণময় হও, শান্তিময় হও, শুভ হও। তোমার অন্তরীক্ষ যেন আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়।

[শান্তিপাঠ ও প্রার্থনা]

আমরা দেবতাদের পবিত্র বাণী শ্রবণ করিতে পাই, আমাদের কর্ণে শুভধ্বনি আসুক।
আমরা ঈর্ষাহীন, পবিত্র দৃষ্টিতে ঈশ্বরকে দর্শন করিতে পারি।
আমাদের অঙ্গ যেন সুস্থ ও দৃঢ় থাকে, এবং আমরা ঈশ্বরীয় কর্মে নিরন্তর রত থাকি।

হে ইন্দ্র ও অগ্নি, তোমরা আমাদের বাকশক্তির মাধ্যমে কল্যাণ কর।
হে মিত্র ও বরুণ, যাঁরা আহূত হইলে আসেন, তোমরাও আমাদের সহায় হও।
হে ইন্দ্র ও সোম, আমাদের কল্যাণে সহায় হও।
হে ইন্দ্র ও পূষণ, আমাদের বিজয়ে সহায় হও।

আমি সদাচারী মানুষকে স্তব করি—
তাঁরা নতুন বাণীর দ্বারা, হে মিত্র ও বরুণ, আমাদের সৌভাগ্য দান করেন।
তাঁরা যেন এখানে আসেন, তাঁরা যেন আমাদের কথা শুনেন।
বরুণ, মিত্র ও অগ্নি, আপনারা সুবিচারশক্তিসম্পন্ন, আমাদের কথা শ্রবণ করুন।

কোন দেৱতা আমাদের সবচেয়ে মঙ্গলময় বন্ধুরূপে আবির্ভূত হইবেন?
কোন শক্তিশালী দেবতা আমাদের আশ্রয় হইবেন?

কে তোমার মধ্যে সর্বোচ্চ সত্য ও আনন্দের আধার,
কে আমাদের মধ্যে ধনসম্পদ সঞ্চয় করিবে?

তুমি আমাদের বন্ধু হও, গায়ক ও যজমানদের রক্ষক হও।
তুমি আমাদের শত উপায়ে রক্ষা কর।

হে পৃথিবী, তুমি আমাদের জন্য কল্যাণময় হও।
তুমি আমাদের স্থির আশ্রয় হও।
তুমি আমাদের নিরাপত্তা দান কর।

ভাষা ঈশ্বরী—
তাঁর ওষ্ঠে আবরণ আছে, দাঁত দিয়ে পরিবেষ্টিত,
তিনিই সকল বাক্যের অধিষ্ঠাত্রী।
তাঁর কণ্ঠ মধুর হওক, আমাদের কণ্ঠেও সৌন্দর্য আসুক।
তিনিই বাকের আধিপতি।

ॐ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।

ओष्ठापिधाना नकुली दन्तैः परिवृता पविः । सर्वस्यै वाच ईशाना चारुमामिह वादयेदिति वाग्रसः ।।
ॐ शान्तिः शान्तिः शान्तिः ।

(১.১.১১.৫.৩)

ওঁ অথ মহাব্রতম্

ইন্দ্র বৃত্রকে বধ করে মহান হয়েছিলেন; সেই মহত্ত্বই হল মহাব্রত। এই মহাব্রতের কারণেই এটি “মহাব্রত” নামে পরিচিত।

এই ব্রতে দুইটি আঘ্য (ঘৃতাহুতি) দেওয়া হয়। কেউ কেউ বলেন একটিই যথেষ্ট, কিন্তু সাধারণত দুইটিই দেওয়ার রীতি আছে।

  • “প্র বো দেবায়াগ্নয়ে” (ঋগ্বেদীয় মন্ত্র) – এই মন্ত্রে আহুতি দিলে সমৃদ্ধি কামনা পূর্ণ হয়।
  • “বিশো বিশো বো অতিথিম্” – এই মন্ত্রে পুষ্টি (ধন-ধান্য) কামনা করা হয়, কারণ “বিশ” (জনগণ) হল পুষ্টির প্রতীক।

কেউ কেউ বলেন, “অতিথি” শব্দটি এখানে উল্লেখযোগ্য, কিন্তু এটি ব্যবহার না করাই ভাল। তবে আচার্যরা বলেন, “যিনি শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেন, তিনিই অতিথি। অসৎ ব্যক্তিকে কেউ অতিথি হিসেবে গ্রহণ করে না।” তাই ইচ্ছা করলে এই মন্ত্র ব্যবহার করা যেতে পারে।

আহুতির মন্ত্রসমূহ:

  1. “আগন্ম বৃত্রহন্তমম্” – এই ত্রিচ (তিনটি ঋকের সমষ্টি) প্রথমে পাঠ করতে হয়।
  2. এই দিনে অনুষ্টুপ ছন্দে তিনটি ত্রিচ পাঠ করা হয়, কারণ:
    • গায়ত্রী হল ব্রহ্ম,
    • অনুষ্টুপ হল বাক্ (বাকশক্তি)।
    • এভাবে ব্রহ্ম ও বাক্যের সংযোগ ঘটে।

অন্যান্য মন্ত্র ও কামনা:

  • “অবোধ্যগ্নিঃ সমিধা জনানাম্” – যশ ও কীর্তি কামনায়।
  • “হোতাজনিষ্ট চেতন” – প্রজা ও পশু কামনায়।

॥ ১.১.১ ॥


কারণ—
“যে মহত্ত্ব অর্জন করে, সেই-ই প্রকৃত ‘অতিথি’।”
অসৎ বা অপুণ্যবান ব্যক্তিকে কেউ অতিথি হিসাবে স্বীকার করে না।
তাই কামনা করেই এই আচরণ করা উচিত।

এই ব্রত সম্পাদন করতে ইচ্ছুক ব্যক্তি এই তিনটি ঋচা পাঠ করবে—
“আগন্ম বৃত্রহন্তমম্” — এই ঋচা প্রথম পাঠ করতে হবে।

এই তিনটি ঋচা, যাঁরা গৃহস্থ জীবন থেকে ব্রহ্মচর্য আশ্রমে গমন করেন, তাঁদের কাম্য।
তাঁরা এক বছরের সাধনায় প্রবৃত্ত হন, এরপর এই ঋচাগুলি পাঠ করেন।

এই তিনটি ঋচার ছন্দ বা মিটার হলো—
অনুষ্টুপ ছন্দ, যার শীর্ষস্থানে গায়ত্রী ছন্দ অবস্থিত।
ব্রহ্মা হল গায়ত্রী, বাক্ (বাকশক্তি বা বাকদেবী) হল অনুষ্টুপ্।
এইভাবে ব্রহ্মার সঙ্গে বাককে যুক্ত করে, সে এই ব্রতের (মহাব্রত) সূত্রপাত করে।

“অবোধ্যগ্নিঃ সমিধা জনানাম্” — এই ঋচা পাঠ করলে কীর্তি লাভ হয়।
“হোতা জনিষ্ট চেতন” — এই ঋচা পাঠ করলে প্রজাপতি ও পশুর কামনা পূর্ণ হয়। ॥ ১.১.১ ॥


“অগ্নিং নরো দীধিতিভিররণ্যোঃ” — এই মন্ত্রটি উচ্চারণ করেন অন্নাদ্য (খাদ্যভোগ) ইচ্ছুক ব্যক্তি। কেননা, অগ্নি হলেন অন্নাদ (খাদক)। পূর্বে যজ্ঞে, বহু প্রস্তুতির পর যজ্ঞকর্মীরা অগ্নির আহ্বান করতেন; কিন্তু এখন মুখ থেকেই সরাসরি অগ্নিকে আহ্বান করা হয়। মুখ থেকে অন্ন গ্রহণ করা হয়, মুখ থেকেই পাপ হ্রাস পায়।

“হস্তচ্যুতি জনয়ন্তি” — অর্থাৎ যজ্ঞকালে কিছুর হাত থেকে পতন ঘটে জন্মের সূচনা হয়, যজ্ঞকারী যেন সেই দিনের জন্মলাভকারী — এই কারণেই তাকে ‘জাতবৎ’ (নতুন জন্মপ্রাপ্ত) বলা হয়।

এই যজ্ঞে চারটি ছন্দ (ছন্দোবৃত্ত) ব্যবহৃত হয়, যেমন পশুর চারটি পা থাকে — এগুলো পশুদের নিয়ন্ত্রণ বা অধিকার করার প্রতীক। আবার তিনটি ছন্দ ব্যবহৃত হয় — এই তিনটি হলো তিনটি লোক (ত্রিভুবন: ভূঃ, ভुवঃ, স্বঃ)-এর প্রতীক, এদের জয় করার লক্ষ্যে। আবার দুটি ছন্দ ব্যবহার করা হয় — যা প্রতিষ্টার জন্য। মানুষ দ্বিপদী (দুই পা) এবং পশুরা চতুষ্পদ (চার পা); যজ্ঞকারী নিজেকে এই দ্বিপদ ও পশুদের চতুষ্পদ প্রকৃতিতে প্রতিষ্ঠা করেন।

এই ছন্দগুলো পরাগ্বচনরূপে (প্রারম্ভিক স্তবক) পঁচিশটি হয় — কারণ পঁচিশটি অঙ্গ (দশটি হাতের আঙুল, দশটি পায়ের আঙুল, দুই উরু, দুই বাহু ও একটি আত্মা) নিয়ে মানুষের শরীর গঠিত। এই পঁচিশটি অঙ্গই এই ‘পঁচিশ’ সংখ্যাটির ভিত্তি — যজ্ঞকারী নিজেকে এই ‘পঁচিশত্মা আত্মা’ হিসেবে সংশোধন করেন।

এই দিনে (যজ্ঞ-দিনে) ‘পঁচিশ’ সংখ্যক স্তোম বা স্তব প্রয়োগ হয় — এইজন্য দুটি পঁচিশ মিলিয়ে পঞ্চাশটি স্তব হয়। এই স্তবগুলি তিনটি প্রথম স্তব, তিনটি উত্তম স্তব ও একটি একক স্তব — এইভাবে ত্রিংশদ (৩০) অক্ষরযুক্ত একটি বিরাট ছন্দ গঠিত হয়। যেখানে সংখ্যা কম থাকে, সেখানেই রেতঃ (বীর্য), প্রাণ, ও অন্নাদ্য শক্তি সঞ্চারিত হয়।

এইভাবে, যিনি এসব জানেন, তিনি সমস্ত কামনা (ইচ্ছা) রুদ্ধ করতে পারেন। এই কামনাগুলো শেষ পর্যন্ত বৃহতী ও বিরাট ছন্দে গিয়ে সংযুক্ত হয়। আবার অনুষ্টুপ্ ছন্দকেও ব্যবহার করা হয়, কারণ আজ্যের (ঘৃতাদি আহুতি) জন্য অনুষ্টুপ্ ছন্দই উপযুক্ত। (১.১.২)

তারা বলেন— “গায়ত্রী ছন্দে প্রউগ (প্রারম্ভিক স্তোত্র) করা উচিত”, কেননা গায়ত্রীই তেজ বা দীপ্তি; ব্রহ্মবর্চস (আধ্যাত্মিক দীপ্তি) গায়ত্রীতেই নিহিত। গায়ত্রী ছন্দ তেজস্বী ও ব্রহ্মবর্চসী করে তোলে।

আবার কেউ বলেন— “ঔষ্ণিহ ছন্দে প্রউগ করা উচিত”, কেননা ঔষ্ণিহ ছন্দই আয়ু— যে ব্যক্তি ঔষ্ণিহে স্তব করে, সে আয়ুবান হয়।

আবার কেউ বলেন— “অনুষ্টুপ্‌ ছন্দে প্রউগ করা উচিত”, কেননা অনুষ্টুপ্‌ ছন্দ হচ্ছে ক্ষত্র (রাজশক্তি), এবং এটি রাজশক্তি অর্জনের জন্য সহায়ক।

আর কেউ বলেন— “বৃহতি ছন্দে (বার্হত ছন্দে) প্রউগ করা উচিত”, কেননা বৃহতি ছন্দেই শ্রী (ঐশ্বর্য) নিহিত; এই ছন্দে স্তব করলে ঐশ্বর্যময় হওয়া যায়।

পুনরায় কেউ বলেন— “পঙ্ক্তি ছন্দে প্রউগ করা উচিত”, কেননা পঙ্ক্তিই অন্ন, এবং এই ছন্দে স্তবকারী অন্নবান হয়।

আবার কেউ বলেন— “ত্রিষ্টুপ্‌ ছন্দে প্রউগ করা উচিত”, কেননা ত্রিষ্টুপ্‌ ছন্দে বীর্য নিহিত; এই ছন্দে স্তব করলে বীর্যবান হওয়া যায়।

আর কেউ বলেন— “জাগতি ছন্দে প্রউগ করা উচিত”, কেননা জাগতী ছন্দেই পশুসমূহ নিহিত, এই ছন্দে স্তবকারী পশুবান হয়।

তবু বলা হয়— গায়ত্রী ছন্দেই প্রউগ করাই উচিত, কারণ গায়ত্রীই ব্রহ্ম; ব্রহ্মই গায়ত্রী। সেইদিনটি ব্রহ্মসম্বন্ধীয় হয়ে উঠে, এবং সেই ব্রহ্মকেই সেই স্তবকারী লাভ করে।

এই স্তব মাধুচ্ছন্দস এর; কারণ “মধু” (সুধা) হরিষিভিন্ন ঋষির নিকট মাধুচ্ছন্দা (ঋষি) বর্ণনা করেছেন, তাই তাঁর নাম হয় মাধুচ্ছন্দস, এবং এই স্তবের নামও তেমনই।

আবার বলা হয়— “অন্নই মধু”, এবং “সমস্তই মধু”, এবং “সমস্ত কামনাই মধু”। এইজন্যই মাধুচ্ছন্দস স্তব করা হয়, যাতে সমস্ত কামনা অধিকার করা যায়।

যে ব্যক্তি এইভাবে জানে, সে সমস্ত কামনা অধিকার করে।

এই প্রউগ একাহিক (একদিনের) যজ্ঞ, রূপ ও ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ, সেইদিন বহু রকম প্রতিষেধ ও নিয়ম থাকে।

সবশেষে সমস্ত প্রশান্তি একত্রিত হয়, কেননা শান্তিই প্রতিষ্ঠার মাধ্যম। সেই শান্তির মাধ্যমেই যজ্ঞের প্রতিষ্ঠা হয়, এবং সকল কিছু শেষ পর্যন্ত শান্তির মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হয়।

যে ব্যক্তি এইভাবে জানে, এবং যার হোতা এইভাবে স্তব করেন, সে-ও প্রতিতিষ্ঠিত হয়।

[সমাপ্ত— ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, প্রথম আরণ্যক, প্রথম অধ্যায়, তৃতীয় খণ্ড (১.১.৩)]

হে বায়ু, এসো! — “ও বায়ু, এসো, এই সোমরস তোমার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে” — এই মন্ত্রে ‘এই দিনটি সফল হোক যজমানের জন্য এবং দেবতাদের জন্য’ এই কামনা নিহিত। এই দিনটি সফল হয় সেই ব্যক্তির জন্য যে এভাবে জানে, এবং যিনি এইভাবে গুণে গুণে পাঠ করে বলেন।

“হে ইন্দ্র ও বায়ু, এই সোমরস প্রস্তুত হয়েছে, এসো!” — ‘নিষ্কৃত’ অর্থাৎ বিশুদ্ধ করা হয়েছে, আর যা বিশুদ্ধ তা-ই ‘সংশ্কৃত’। যিনি এই কথা জানেন এবং যিনি এটি পাঠ করেন, তাঁদের জন্য ইন্দ্র ও বায়ু এই বিশুদ্ধ সোমরস গ্রহণ করেন।

“আমি পুতদক্ষ মিত্রকে আহ্বান করি, যিনি বিশুদ্ধ বুদ্ধির অধিকারী” — এখানে ‘ধী’ অর্থাৎ বুদ্ধি এবং ‘ঘৃতাচী’ মানে হচ্ছে সুগন্ধি, দীপ্তিময় ভাষা। ভাষা-ই সেই ধী বা ঘৃতাচী, যিনি এইভাবে জানেন, তাঁর কণ্ঠে সেই বাণী প্রতিষ্ঠিত হয়।

“হে অশ্বিনীকুমার, যজ্ঞকার্যের জন্য এসো” — এখানে ‘ঋষি’ মানে অন্ন; অন্নই হচ্ছে ইচ্ছার বস্তু, এবং যিনি আহার করেন তিনি অন্নাদ্য। এই মন্ত্রের মাধ্যমে আহার ও আহার্য শক্তিকে বজায় রাখা হয়।

“এসো, তোমরা রুদ্রগমনপন্থী অশ্বিনীকুমার” — যিনি এইভাবে জানেন এবং এইভাবে মন্ত্র পাঠ করেন, তাঁর জন্য অশ্বিনীকুমারগণ যজ্ঞে উপস্থিত হন।

“ইন্দ্র, এসো, তুমি দীপ্তিময়, ইন্দ্র, এসো, তুমি চিন্তাশীলদের দ্বারা আহ্বানিত, ইন্দ্র, এসো, তুমি গীতির দ্বারা আহ্বানিত” — “এসো, এসো” — এইভাবেই গাওয়া হয়। যিনি এইভাবে জানেন এবং এইভাবে পাঠ করেন, তাঁর জন্য ইন্দ্র উপস্থিত হন।

“ওম, আশ্বিনীকুমার ও অন্যান্য বিশ্বদেবগণ, তোমরা সবাই এসো” — যিনি এইভাবে জানেন এবং এইভাবে পাঠ করেন, তাঁর জন্য সমস্ত দেবতারা আহ্বানে সাড়া দেন।

“দানের যোগ্য ব্যক্তিরা, যিনি দেন তাঁর জন্য প্রস্তুতকৃত সোমরস” — এখানে যিনি দেন তিনিই দেবতাদের প্রসন্ন করেন। যিনি এই কামনা করেন, তাঁকে দেবতারা সেই কাম্য বস্তু দেন।

“পবিত্র সরস্বতী আমাদের যজ্ঞ ও বুদ্ধিকে রক্ষা করুন” — সরস্বতী হলেন ভাষার দেবী এবং ধী বা বুদ্ধি ও ভাষার আধার। যিনি এইভাবে জানেন ও পাঠ করেন, তাঁর মধ্যে ভাষা প্রতিষ্ঠিত হয়।

“যজ্ঞ রক্ষা করুক” — বলা হয় “যজ্ঞ বহন করুক” — উভয়ই সমার্থক।

এই স্তোত্রে একবিংশতি (২১)টি স্তব রয়েছে। ‘একবিংশ’ (২১) পুরুষ হল আত্মা— দশটি হাতের আঙুল, দশটি পায়ের আঙুল, এবং আত্মা মিলে ২১। এইভাবে আত্মাকে বিশুদ্ধ করা হয়।

এগুলি প্রথম স্তরে তিনবার এবং শেষ স্তরে তিনবার গাওয়া হয়— মোট ২৫ বার। ২৫ হচ্ছে আত্মার সংখ্যা, প্রজাপতির সংখ্যাও ২৫। দশ হাতের আঙুল, দশ পায়ের আঙুল, দুটি উরু, দুটি বাহু, ও আত্মা— এভাবে ২৫ অঙ্গ মিলিয়ে আত্মাকে বিশুদ্ধ করা হয়।

এই ২৫ বার পাঠ এবং ২৫ সংখ্যা দিনকেও পূর্ণ করে। এই কারণে দুইবার ২৫টি স্তব গাওয়া হয়।

ঐতরেয় ব্রাহ্মণ আরণ্যক, প্রথম আরণ্যক, প্রথম অধ্যায়, চতুর্থ খণ্ড (১.১.৪), এবং: বহবৃচ ব্রাহ্মণ আরণ্যক, প্রথম আরণ্যক, প্রথম অধ্যায় সমাপ্ত।

“আ ত্বা রথং যথোতয় ইদং বসো সুতমন্ধ” — এই ঋচা ‘মরুত্বতীয়’ সূক্তের অংশ। এটি প্রাতঃস্মরণীয় দিনে প্রতিপদ থেকে অনুচর ক্রমে ব্যবহৃত হয়। এটি একাহিক রূপে সমৃদ্ধ, অর্থাৎ একদিনের জন্য সম্পূর্ণ আচারবিধিতে সম্পন্ন হয়। ঐ দিনে বহু রূপে, বহু আঙ্গিকে অনুক্রম ও বিধান অনুসারে উপাচার ও নিয়ম পালন করা হয়।

শান্তির মাধ্যমেই শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। একাহিক যজ্ঞ শান্তির মধ্য দিয়েই প্রতিষ্ঠা পায় এবং পরিণামে শান্তিতেই সকল কিছু অবলম্বিত হয়— এভাবে যে ব্যক্তি তা জানে, সে স্থিত হয় এবং তার জন্য যে হোতা এইরূপে স্তব করে, তারও কল্যাণ হয়।

“ইন্দ্র নেদীয় এদিহি প্রসূতিরা শচীভির্যে ত উক্থিন” — এই মন্ত্রটি উক্থ্য (স্তুতি) বাচক, এবং এটি উক্থবৎ (উক্থবাচক) রূপে ঐ দিনের একটি রূপ।
“প্রৈতু ব্রহ্মণঃ পতিরচ্ছা বীরম্” — এই মন্ত্রটি বীরবৎ রূপে ঐ দিনের আরেকটি রূপ নির্দেশ করে।
“উত্তিষ্ঠ ব্রহ্মণঃ পতেঃ সুবীর্যম্” — বীর্যবৎ রূপ নির্দেশ করে।
“প্র নূনং ব্রহ্মণঃ পতির্মন্ত্রং বাদত্যুক্থ্যম্” — এটি আবার উক্থ্যবৎ রূপের প্রতিফলন।

“অগ্নির্নেতা স বৃত্রহে” — এটি বৃত্রনাশী ইন্দ্রস্বরূপ, যাকে ‘মৈন্দ্র’ রূপ বলা হয়েছে।
“ত্বং সোম ক্রতুভিঃ সুক্রতুর্ভূঃ ত্বং বৃষা বৃষত্বৈভির্মহিত্বা” — এটি ইন্দ্রের ‘বৃষাণ্বৎ’ রূপ, সেই দিনের মৈন্দ্র রূপ।
“পিন্বন্ত্যপো’ত্যম্ ন মিহে বিনয়ন্তি বাজিনম্” — এটি ‘বাজিমান’ ইন্দ্রের রূপ।
“অথো উৎসং দুহন্তি স্তনয়ন্তমক্ষিতম্” — এটি ‘স্তনয়দ্‌বৎ’ রূপে ইন্দ্রস্বরূপ, সেই দিনের মৈন্দ্র রূপ।
“প্র ৱ ইন্দ্রায় বৃহৎ” — যেহেতু ‘বৃহৎ’, সেহেতু তা ‘মহৎ’, এইভাবে মহৎ রূপে সেই দিনের রূপ।
“বৃহদিন্দ্রায় গায়তে” — এ-ও মহৎ রূপ নির্দেশ করে।
“নকিঃ সুদাসো রথং পর্যাস ন রীরমদ্” — এটি ‘পর্যস্তবৎ’ তথা অন্তিমরূপ সমৃদ্ধ রূপ।

অতঃপর, যিনি এই প্রকারে সকল প্রগাথা স্তব করেন, তিনি সকল দিনের, সকল উক্থ, সকল পৃষ্ঠ, সকল শস্ত্র, সকল প্রউগ, সকল সবনের অধিগম লাভ করেন — এইভাবে সকল কিছু অধিকার করেন।

ঐতরেয় ব্রাহ্মণ আরণ্যককাণ্ডের প্রথম আরণ্যের দ্বিতীয় অধ্যায়ের প্রথম খণ্ড (১.২.১) ।

“অসৎসু মে জরিতঃ সাভিবেগঃ”— (ঋষি বলেন) যখন অসত্যের মধ্যে আমি প্রবেশ করি, তখন আমার অন্তরের কবি (চেতনা) উত্তেজিত হয়ে ওঠে। সে সত্যের দিকে দৃঢ়তার সঙ্গে অগ্রসর হয়। এইভাবেই সত্যকে গাওয়া হয়—এ হল সেই দিনের রূপ, যা সত্যবাদিতা ও গুণে পূর্ণ।

এই দিনের রূপ হল “ব্রহ্ম”—একে বলা হয় “বাসুক্র”। বাস্তবিকই বাসুক্র মানে ব্রহ্ম। এই দিন ব্রহ্মরূপেই উপলব্ধ হয়।

তাই বলা হয়—”কেন বাসুক্ররূপেই মারুৎত্বীয় স্তোত্রকে উপলব্ধ করা হয়?”—কারণ বাসুক্র ব্যতীত অন্য কেউ কখনও মারুৎত্বীয় স্তোত্রকে উচ্চারণ করেনি। তাই কেবল বাসুক্রের দ্বারাই তা প্রাপ্ত হয়।

এরপর এক অনির্বচনীয় প্রজাপত্য স্তোত্র গাওয়া হয়, কারণ প্রজাপতি নিজেই অনির্বচনীয়। এটি প্রজাপতির উপলব্ধির জন্য গাওয়া হয়।

“সকৃত্‌ ইন্দ্রং নিরাহ”—যিনি একবার ইন্দ্রের স্তব করেন, তিনি ইন্দ্রীয় শক্তি থেকে বিচ্যুত হন না।

“পিবা সোমমভি যমুগ্র তরদ”—এই স্তব বলে আহ্বান করা হয়: হে উগ্র ইন্দ্র, তুমি সোমপান করো।

“ঊর্বর গব্যং মহি গৃণান ইন্দ্র”—এই স্তোত্রে দিনের বিশালতাকে গাওয়া হয়, ইন্দ্রের গৌরবের রূপ হিসাবে।

এরপর “ভারদ্বাজ” স্তোত্র উচ্চারিত হয়—ঋষিদের মধ্যে ভারদ্বাজই সর্বাধিক জ্ঞানী, দীর্ঘায়ু ও তপস্বী ছিলেন। তিনি এই স্তোত্র দিয়ে পাপ থেকে মুক্ত হন। এই স্তোত্র গাওয়ার উদ্দেশ্য তাই পাপ মোচন, দীর্ঘায়ু, তপস্যায় স্থিত হওয়া।

“কয়া শোভা সবয়সঃ সনীলা”—এই স্তোত্র গাওয়া হয়। এটি আহ্নিক স্তব, অর্থাৎ প্রতিদিনের রূপ প্রকাশ করে।

এই স্তোত্রকে বলা হয় “কয়া শুভীয়ম্”—এটি একটি যুক্তিক স্তোত্র। ইন্দ্র, অগস্ত্য ও মারুৎগণ এই স্তোত্রের মাধ্যমে নিজেদের পারস্পরিক পরিচয় বুঝতে পেরেছিলেন। তাই এই স্তোত্র গাওয়ার অর্থ হচ্ছে জ্ঞান বা পারস্পরিক চিন্তা উপলব্ধি।

এটিকে বলা হয় “বায়ুষ্য” স্তোত্র, যা সেই ব্যক্তি গাইবে, যে যজ্ঞ কর্তাকে প্রিয়।

“মরুৎবান্ ইন্দ্র বৃষভো রণায়”—এই স্তোত্র গাওয়া হয়, যার অর্থ ইন্দ্র হলেন বীর, যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত।

“ইন্দ্র বৃষভ” অর্থাৎ ইন্দ্রের শক্তিশালী রূপ গাওয়া হয়। এটি সেই দিনের ইন্দ্রীয় শক্তির রূপ।

এরপর “বৈশ্বামিত্র” স্তোত্র—বিশ্বের বন্ধু যিনি, তিনিই বৈশ্বামিত্র। যিনি এইভাবে জানেন, তিনি সমস্তের বন্ধু হন। যাঁর জন্য এই হোতা এই স্তোত্র গায়, তিনি এমন বন্ধু হন।

“জনিষ্ঠা উগ্রঃ সহসে তুরায়”—এই স্তোত্রটি একদিনে, গভীরভাবে, সম্পূর্ণ উদ্দীপনার সঙ্গে গাওয়া হয়। বহু কিছুতে এর প্রয়োগ হয়, অনেক বাধাও প্রতিহত হয়। শান্তির জন্য এই স্তোত্র, এবং এর মাধ্যমে যজ্ঞের প্রতিষ্ঠা হয়।

এই স্তোত্রগুলি ৭৯টি। এর মধ্যে ৯০টি গঠন করে তিন স্তর বিশিষ্ট ত্রিংশিনী বিরাজ স্তোত্রসমূহ। ৭টি অতিরিক্ত স্তব হল প্রশংসা স্তোত্র—এই সাতটিকে বলা হয় “সাপ্ত্য” স্তব।

এইভাবে, প্রাথমিক তিন স্তরে এবং শেষের তিন স্তরে—মোটে একশটি স্তোত্র হয়।

পাঁচটি আঙুল, চারটি গাঁট, দুই কাঁধ, দুই বাহু, দুই চোখ ও অন্যান্য অঙ্গ মিলিয়ে ২৫টি অঙ্গ, এবং ১০০টির মধ্যে শেষটি হল আত্মা, একশতম অংশ। এই আত্মা হল আয়ু, ইন্দ্রিয়, বীর্য ও তেজ—এই চারটিতে যজ্ঞকারী প্রতিষ্ঠিত হন।

এই স্তোত্রগুলি ত্রিষ্টুভ্‌ ছন্দে গাওয়া হয়, কারণ ত্রৈষ্টুভ্‌ ছন্দই মধ্যাহ্ন রূপ।

“ঐতরেয় ব্রাহ্মণ”, আরণ্যককাণ্ড, প্রথম আরণ্যক, দ্বিতীয় অধ্যায়, দ্বিতীয় খণ্ড

তদাহুঃ— তখন ঋষিরা বলেন : “এই যে ‘প্রেঙ্খ’—তার প্রেঙ্খত্ব (দোলন) কীসাথে সম্পর্কিত?” উত্তরে বলা হয়—“এই যে প্রবাহমান বায়ু, সেই-ই প্রকৃত প্রেঙ্খ, কারণ তিনিই এই সব জগতে দোলিত হচ্ছেন। সুতরাং তিনিই প্রেঙ্খত্বের আধার।”

একং ফलনি স্যাত্ ইত্যাহুঃ— কেউ বলেন, “একমাত্র একটি ফলক (আধার) রয়েছে,” কারণ এই বায়ুই একমাত্র একধারায় প্রবাহিত হচ্ছেন এবং তার এই রূপের মধ্যেই তিনি বিদ্যমান। এই মত অবাস্তব, গ্রহণযোগ্য নয়।

ত্রীণি ফলকানি স্যুরিতি— আবার অনেকে বলেন, “তিনটি ফলক রয়েছে”—কারণ এই তিনটি জগত (স্বর্গ, পৃথিবী, এবং অন্তরীক্ষ) ত্রিভৃতি রূপে রয়েছে, এবং বায়ু এই ত্রিভৃতি জগতের মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছেন। এই মতও অগ্রহণযোগ্য।

দ্বে স্যাতাম্ ইতি কেউ বলেন, “দুটি ফলকই থাকা উচিত”—কারণ এই দুটি জগত (পৃথিবী ও স্বর্গ) যেন পরস্পর সমবদ্ধভাবে দেখা যায়, আর যেটি তাদের মাঝে অবস্থান করছে, সেটিই হল আকাশ বা অন্তরীক্ষলোক। এই জন্য বলা হয়, “দুটি ফলকই থাকা উচিত।”

আউদুম্বর স্যাতাম্— এই দোলনা কাঠামো ‘উদুম্বর’ কাঠের হওয়া উচিত, কারণ উদুম্বর খাদ্য ও শক্তির আধার, এবং তা দোলনার মাধ্যে প্রতিষ্ঠার জন্য উপযোগী।

মধ্যতঃ উদ্ধৃতে স্যাতাম্— দোলনাটি যেন মাঝখান থেকে ঝোলানো থাকে, কারণ জীবেরা মধ্যস্থলে বসেই খাদ্য আহরণ করে। সেইজন্য দোলনাটি মাঝখান থেকেই ঝুলতে হবে, যাতে যজমান অর্থাৎ যজ্ঞকারী সেই খাদ্যের উপকার পায়।

উভয়্যো রজ্জবঃ ভবন্তি— দোলনার জন্য দু’পাশে (ডান ও বাম) দুটি দড়ি থাকবে—ডান পাশেরটি কিছু পশুর রজ্জু এবং বাম পাশেরটি অন্য কিছু পশুর রজ্জু। যখন উভয় রজ্জু ব্যবহৃত হয়, তখন তা সমস্ত পশুর অর্জনের প্রতীক হয়ে ওঠে।

দার্ভ্যঃ স্যুঃ— দোলনার আসন যেন ‘দরভ’ (কুশ ঘাস) দিয়ে প্রস্তুত হয়। কারণ কুশ হলো ঔষধিগুলির মধ্যে এক পবিত্র ঘাস এবং পাপনাশক। সেই জন্য দার্ভ্য (দরভযুক্ত) আসন গ্রহণ করা উচিত।

ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, আরণ্যককাণ্ড, প্রথম আরণ্যক, দ্বিতীয় অধ্যায়, তৃতীয় খণ্ড (৩)৭।

ভূমির উপরে এক ‘অরত্নি’ পরিমাণ উচ্চতায় ঝুলন্ত দোলনায় (প্রেঙখ) আরোহণ করা উচিত — এমনই বলা হয়, কেননা এইটুকু উচ্চতাতেই স্বর্গলোকের পরিমাপ সম্পূর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু এটি কিছু বিশেষজ্ঞের মতে গৃহীত নয়।

আবার কেউ বলেন, ‘প্রদেশ’ পরিমাণ (এক হাতের তালু পরিমাণ) উচ্চতায় দোলনাটি হওয়া উচিত, কেননা এইটুকু স্থানেই প্রাণসমূহ পরিমিত হয়। এটিও অনেকে গ্রহণ করেন না।

আবার কেউ বলেন, ‘মুষ্টি’ পরিমাণ উচ্চতায় হওয়া উচিত, কেননা এইটুকু উচ্চতাতেই সমস্ত অন্ন ও আহার্য তৈরি হয় ও গ্রহণযোগ্য হয়। অতএব ‘মুষ্টি’ পরিমাণই যুক্তিযুক্ত বলে ধরা হয়।

কেউ বলেন, পূর্বদিকে ও পশ্চিমদিকে মুখ করে দোলনায় আরোহণ করা উচিত, কেননা সূর্য পূর্বদিকে উদিত হয়ে এই সকল লোককে উত্তরণ করায়। কিন্তু এটিও অনেকে গ্রহণ করেন না।

আবার কেউ বলেন, তির্যকভাবে (আড়াআড়ি) আরোহণ করা উচিত, যেমন ঘোড়ায় আরোহণ করে সমস্ত কামনা পূর্ণ করা হয়। এটিও গৃহীত নয়।

কেউ বলেন, পশ্চাৎমুখে আরোহণ করা উচিত, যেমন নৌকায় পশ্চাৎমুখে বসে আরোহণ করা হয়; কারণ এই দোলনা এক প্রকার স্বর্গগামী নৌকার মতো। তাই পশ্চাৎমুখেই আরোহণ করা উচিত।

আবার কেউ বলেন, চিবুক স্পর্শ করে আরোহণ করা উচিত; যেমন শকুন এইভাবে গাছে আরোহণ করে এবং সে পাখিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ আহারকারী হয় — অতএব এইভাবে স্পর্শ করেই আরোহণ করা উচিত।

কেউ বলেন, বাহু দিয়ে আরোহণ করা উচিত; যেমন শ্যেন (বাজ) গাছে বা শিকার ধরতে বাহু বিস্তার করে, এবং সে পাখিদের মধ্যে সবচেয়ে বলশালী। অতএব বাহু দিয়ে আরোহণ করাই যুক্তিযুক্ত।

এই দোলনার একটিও পা (খুঁটি) কাটা উচিত নয়, কেননা সেটি দোলনার স্থিতি বিনষ্ট করবে।

হোতা পুরোহিত এই দোলনায় আরোহণ করেন, যা উদুম্বর কাঠের আসনের সদৃশ এবং ঊদ্গাতা (যিনি মন্ত্রোচ্চারণ করেন) রমণী সদৃশ আসনে বসেন। এই দোলনা হল একপ্রকার দম্পতি (পুরুষ ও নারী) এবং এই দম্পতিকে ঊক্তি মন্ত্রের মাধ্যমে মিলিত করে থাকে— যাতে প্রজা ও পশুর প্রজনন ঘটে। যে এইভাবে জানে, তার প্রজাবৃদ্ধি ঘটে।

আবার, এই দোলনা হল অন্ন এবং আসন হল লক্ষ্মী। অন্ন ও লক্ষ্মী একসাথে আরোহন করেন।

বৃহৎ আসনে হোত্রগণ এবং সব ব্রহ্মবাদী পুরোহিতেরা একসাথে আরোহণ করেন।

যেমন ঔষধি ও বৃক্ষেরা উপরে উঠে ফল ধারণ করে, তেমনি এই দিনে সকলেই একত্রে আরোহণ করলে তাঁরা ঊর্জা (উত্সাহ, বল) ও আহার্য আহরণ করেন — যা আহার্য শক্তিকে রক্ষা করে।

কেউ বলেন, “বষট্” উচ্চারণ করে নিচে নামা উচিত। তবে এটি গৃহীত নয়, কারণ তা যথাযথ আচরণ নয় — এটি এমন আচরণ যা অশ্রদ্ধার প্রতীক।

আবার কেউ বলেন, মুখে খাবার নিয়ে নিচে নামা উচিত। এটিও গৃহীত নয়, কারণ এটি ধৃষ্টতা নির্দেশ করে।

কেউ বলেন, খাবার গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করে তারপর নিচে নামা উচিত, কেননা এটিই যথাযথ আচরণ।

পূর্বদিকে মুখ করে নিচে নামা উচিত, কেননা দেবতারা পূর্বদিক থেকেই উৎপন্ন হন। সুতরাং পূর্বদিকে মুখ করে নিচে নামতে হবে।

ঐতরেয় ব্রাহ্মণ আরণ্যক গ্রন্থের প্রথম আরণ্যকের দ্বিতীয় অধ্যায়ের চতুর্থ খণ্ড। এটি ঋগ্বেদের বহ্বৃচ ব্রাহ্মণ শাখার অংশ।

১.৩.১
“হিংকার” ধ্বনির দ্বারা এই দিনটি (অর্থাৎ যজ্ঞের দিন) শুরু হয়— এমনটিই বলা হয়ে থাকে। কারণ হিংকারই হল ব্রহ্ম, এবং সেই দিনটিও ব্রহ্মস্বরূপ, সুতরাং হিংকারের মাধ্যমেই সেই ব্রহ্ম উপলব্ধ হয়— যে এইরূপ জানে।
যেহেতু হিংকার ধ্বনির দ্বারা এটি উপলব্ধ হয়, অতএব— হিংকার হল পুরুষ, ও ‘উক্ত’ (স্ত্রী), এরা মিলনে লিপ্ত হলে সেই হিংকারই এক যৌগিক দ্বিত্ব (মিথুন) রূপ পায়। আর সেই যৌগিকরূপ হিংকার যজ্ঞে উপস্হাপিত হলে উৎপত্তি ঘটে প্রজা ও পশুর। যে এইভাবে জানে, সে প্রজাবৃদ্ধি ও পশুবৃদ্ধি লাভ করে।
আবার, হিংকারধ্বনির দ্বারা এই উপলব্ধি যেমন ঘটে, তেমনই যেন আকাশের মতো সেই ব্রহ্মরূপ হিংকার সমস্ত কিছু ঢেকে রাখে এবং আচ্ছাদন করে।
যে কামনাকে কেউ কামনা করে, হিংকার ধ্বনির দ্বারাই সে যেন তাকে লাভ করে— যে এইরূপ জানে।
এই উপলব্ধি (হিংকার দ্বারা) হল বাক্‌ (বাক্য) শক্তির একটি বিভাজন— যা দেবত্ব ও মানবত্বকে পৃথক করে। এই হিংকার ধ্বনির দ্বারা বাক্য-রূপ পৃথকীকরণ ঘটে দেবত্ব ও মানবত্বের মধ্যে।

১.৩.২
এখন বলা হয়, কে এই দিনটির (যজ্ঞদিনের) প্রথম উপলব্ধি করেন?— মন ও বাক্‌ (বাক্য), এমনই বলা হয়।
সমস্ত কামনা অন্য কিছুর মধ্যে আশ্রিত থাকে, কিন্তু মন সমস্ত কামনাকে ধারণ করে। কারণ মন দিয়েই সমস্ত কামনা চিন্তা করা যায়।
এইরূপে, মনেই সমস্ত কামনা আশ্রয় পায়— যে এইরূপ জানে।
আর বাক্য সমস্ত কামনা দোহন করে, কারণ বাক্য দ্বারাই কামনার প্রকাশ ঘটে। যে এইরূপ জানে, তার পক্ষে বাক্য সমস্ত কামনা দোহন করে।
তদ্ব্যতীত বলা হয়, এই যজ্ঞদিন হোক না কোনো ঋক্‌ মন্ত্র, না কোনো যজুঃ মন্ত্র, না কোনো সাম মন্ত্র দ্বারা সরাসরি উপলব্ধিযোগ্য; এটি ঐসব দ্বারা উপলব্ধ হয় না, এমনই বলা হয়।
এই কারণে, যজ্ঞে “ব্যাহৃতি” মন্ত্রগুলি (ভূঃ, ভুবঃ, স্বঃ) আগে জপ করা উচিত।
এই ব্যাহৃতিগুলিই হল তিনটি বেদ: ভূঃ = ঋগ্‌বেদ, ভুবঃ = যজুর্বেদ, স্বঃ = সামবেদ।
এই কারণেই বলা হয়, এই দিন (যজ্ঞ) ঋক্‌, যজুঃ, বা সাম দ্বারা সরাসরি উপলব্ধ হয় না— বরং এই ব্যাহৃতি দ্বারা উপলব্ধ হয়।

১.৩.৩

“তৎ” শব্দ দ্বারা বস্তুকে অনুধাবন করা হয়। আবার “তত্তৎ” বলেও তা অনুধাবিত হয়। ‘আন্ন’—অর্থাৎ খাদ্যই সেই বস্তু যা এইভাবে অনুধাবিত হয়। এই একাক্ষর ও দ্ব্যক্ষরযুক্ত বাক্যপ্রয়োগ প্রজাপতি প্রথম উচ্চারণ করেছিলেন—”তৎ”, “তৎ”, “তৎ”, এইরূপ। অনুরূপভাবে একটি শিশু যখন প্রথম কথা বলে, তখন এক ও দুই অক্ষরের মাধ্যমে “ততে”, “তাতে” বলে—এইভাবেই সে বাক্যের দ্বারা বস্তু অনুধাবন করে।

ঋষি একে এইভাবে ব্যাখ্যা করেছেন—”বৃহস্পতি প্রথমে বাক্যের অগ্রভাগ উচ্চারণ করেছিলেন”—এইটিই সেই বাক্যের প্রথম অগ্রভাগ। “যিনি পূর্বে নাম ধারণ করে প্রেরিত হয়েছিলেন”—এই বাক্য দ্বারা বোঝানো হয়, বাক্য দ্বারাই নামসমূহ নির্ধারিত হয়। “যা তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও প্রথম” সেইটিই প্রকৃত শ্রেষ্ঠ, সেইটিই প্রথম। সেই সর্বশ্রেষ্ঠতাকে তাঁরা উপলব্ধি করেছিলেন আত্মিক গুপ্ত অভ্যন্তর থেকে, আবার দেবত্বের প্রকাশরূপেও উপলব্ধি করেছিলেন। এইভাবেই তা বলা হয়ে থাকে।

১.৩.৪

এটি ভাবা হয়—“এই-ই ভুবনসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।” কারণ সে যেইজন জন্মেছিল, তিনি ছিলেন উগ্র, তেজস্বী, নরত্বপূর্ণ। এইজন্যেই বলা হয়—তিনি যেহেতু জন্মগ্রহণ করলেন, তিনি উগ্র, তেজস্বী, নরত্বপূর্ণ। জন্মমাত্রই তিনি শত্রুদের ধ্বংস করেন—জন্মগ্রহণ করেই তিনি পাপকে অপসারিত করেন।

সমস্ত ভূতগণ তাঁকে অনুগত হয়ে আনন্দিত হয়, এইভাবে তিনি ঊর্ধ্বদিকে উঠে যান। তিনি বীর্য ও বলশক্তিতে বৃদ্ধি লাভ করেন। তিনি শত্রুর জন্য আতঙ্ক উৎপন্ন করেন। তিনি জীবিত ও অজীব সকলকেই জয় করেন। “সমস্ত মদে বিজয়ী হয়েছেন”—এর অর্থ, সমস্ত কিছুই তাঁর অধীন। “সমস্ত জীব ও মন এবং সমস্ত যজ্ঞ তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়”—এর অর্থ, সমস্ত সত্তা, মন ও যজ্ঞ তাঁকেই কেন্দ্র করে।

এই ‘উমা’ নামক সত্তারা যেহেতু তিনবার জন্মগ্রহণ করে, তা বোঝায়—দুইজন মিলে এক দম্পতি উৎপন্ন হয়, প্রজার জন্য। যিনি এভাবে জানেন, তিনি প্রজা ও পশু উৎপন্ন করতে সক্ষম হন। “আস্বাদনীয়ের থেকেও আস্বাদনীয়, আস্বাদনীয় দ্বারা সৃষ্টি করে”—এই বাক্যে বোঝানো হয়েছে, প্রজা হল স্বাদু, এবং দম্পতির দ্বারাই প্রজা সৃষ্টি হয়। “মধুর দ্বারা আক্রমণ করে”—এর অর্থ, দম্পতি মধুরূপ এবং দম্পতির দ্বারাই প্রজার আক্রমণ বা বিস্তার ঘটে।

ঋষি বলেন—“যিনি নিজের দেহ প্রসারিত করেন”—এই দেহরূপ ছন্দময় বাক্যরূপে বুঝানো হয়েছে। “এই দেহই হোক চিকিৎসা”—এই বাক্যে বোঝানো হয়েছে, এই শারীরিক ছন্দময় বাক্যই যেন ওষধরূপে কার্যকর হয়।

এই দেহরূপ বাক্যে যেই আটটি অক্ষর আছে, তাই গায়ত্রী; যেগুলি এগারোটি, তাই ত্রিষ্টুব্‌; যেগুলি বারোটি, তা জগতী; দশটি হলে তা বিরাট। এই দশ ও তার বেশি অক্ষরের মধ্যে তিনটি ছন্দে এই বাক্য প্রতিষ্ঠিত। “পুরুষ” শব্দটি তিন অক্ষরের এবং সেটাই ‘বিরাট’। এইভাবে, এই সমস্ত ছন্দই ‘বিরাট’ রূপে পরিগণিত। যিনি এমনভাবে জানেন, তাঁর সেই দিন (যজ্ঞ বা উপলব্ধির মুহূর্ত) সমস্ত ছন্দের দ্বারা অনুধাবিত হয়।

১.৩.৫

যখন সে নদীতে (রূপক অর্থে) বিচরণ করে, তখন তাকে “পুরুষ” বলে। কারণ, ‘নদ’ (স্বর) থেকে সে কথা বলে এবং সকলেই তার সাথে সুর মিলিয়ে কথা বলে—এইভাবেই উচ্চারণ প্রসঙ্গ এসেছে।

“নদ” অর্থে স্ত্রীরাও বোঝানো হয়েছে—যেমন, যেসব জল (আপঃ) স্বর্গীয়, তারাই সমস্ত জগৎকে ধৌত করে। আবার, যেসব প্রধান বা গুরুত্বপূর্ণ আপঃ, তারাই সমস্ত খাদ্য ও জীবনের উৎসকে শুদ্ধ করে। “নদ” শব্দের আরেক অর্থ হল—তরুণীরা, যাঁরা অন্তরীক্ষে (মধ্যলোকে) বিচরণ করে, যেন জলে ভেসে চলে।

“পতি” শব্দের ব্যবহার হয়েছে সেই জলসমূহের জন্য যা ধোঁয়া (আগুনের ধোঁয়া) থেকে উৎপন্ন। আবার ‘অঘ্ন্যা’ শব্দের মাধ্যমে সেই জল বোঝানো হয়েছে যা শুক্রবীজ থেকে উৎপন্ন।

“ধেনু” অর্থে সেই জল, যা সমস্ত কিছুকে পুষ্ট করে। এইভাবে সূক্ত ও ছন্দগুলোর মাধ্যমে এইদিনটি (অর্থাৎ বেদীয় কর্মফলপ্রদানকারী দিন) চিহ্নিত হয় ২৫ সংখ্যায়। ২৫ অঙ্গ — ১০ আঙ্গুল, ১০ পায়ের আঙুল, ২ ঊরু, ২ বাহু এবং আত্মা—এই ২৫ দ্বারা আত্মাকে সমৃদ্ধ করা হয়। এটি “পঞ্চবিংশ” স্তোত্র।

১.৩.৬

তদ্ ইতি প্রতিপদ্যতে, তত্তদ্ ইতি বা। অন্নম্ অন্নম্ এব তদ্ অভিপ্রতিপদ্যতে, ইতি। — ‘তদ্’ এই শব্দ দ্বারাই প্রতিপাদন ঘটে, অথবা ‘তত্তদ্’ এই রূপে। ‘অন্ন’, ‘অন্ন’ এই বলিয়াই সেই বস্তুটিকে অভিপ্রতিপাদন করা হয়।

— এই যে বচন, এটিই প্রজাপতি সর্বপ্রথম উচ্চারণ করেছিলেন, যা একাক্ষর ও দ্ব্যক্ষরবিশিষ্ট— “ততে”, “তাতে” এইভাবে।

— ঠিক এইভাবে শিশুও, যখন প্রথম কথা বলতে শেখে, তখন এক ও দুই অক্ষরের এই বচনই উচ্চারণ করে— “ততে”, “তাতে”।

— এবং সেই একই “ততে ততে”-রূপ বচনের দ্বারা বস্তুকে প্রতিপাদন করা হয়।

তদুক্তং ঋষিণা— “বৃহস্পতেঃ প্রথমং বাচো অগ্রম্” ইত্যেতদ্ধ্যেব প্রথমং বাচো অগ্রম্। — এই কথাই ঋষি বলেছেন: “হে বৃহস্পতি! বাচের প্রথম অগ্র” — এই অংশটাই বচনের প্রথম।

— যখন বচনে নামধারণ করা হয়, তখন সেই নামই প্রেরিত হয়।

— কারণ নামসমূহ বচনের দ্বারাই ধারিত ও স্থির হয়।

“যদেষাং শ্রেষ্ঠং, যদ্ অরিপ্রম্ আসীত্” ইত্যেতদ্ধ্যেব শ্রেষ্ঠম্, এইতদ্ অরিপ্রম্। — যা তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, যা অরিপ্র (অতিরিক্ত, উৎকৃষ্ট) ছিল, সেটিই শ্রেষ্ঠ ও অরিপ্র।

— সেই প্রেরণাই তাদের মধ্যে গুহায় নিহিত হয়েছে, এবং পরিশেষে প্রকাশিত হয়।

“ইদম্ উ হ গুহা-অধ্যাত্মম্, ইমাঃ দেবতা, অদ উ, আঽরধি-দৈবতম্” ইতি। — এই যে, এটাই গুহারূপ অন্তর্যামী সত্য— এই দেবতাগণ অন্তরে অবস্থান করেন; এবং অতঃপর প্রকাশ হয়ে দাঁড়ান দৈবত রূপে।

এতৎ তদ্ উক্তং ভবতি, ইতি। — এইভাবেই এ বক্তব্যটি বলা হয়েছে।

এটাই এই সমস্ত ভূবনে শ্রেষ্ঠ, এইরূপে অনুধাবিত হয়। যা কিছু শ্রেষ্ঠ, তাই মহৎ—এটি মহৎ রূপে পরিপূর্ণ, এটাই দিনের রূপ।

“তোমার সে কীর্তি, হে মঘবত্, মহত্ত্বে পরিপূর্ণ হয়ে উঠুক”—এইরূপে বলা হয়, অর্থাৎ মহত্ত্বের রূপে দিন সমৃদ্ধ।

“তুমি আরও বিশাল হও, বীরত্বে”—এইরূপে বলা হয়, অর্থাৎ বীরত্বের রূপে দিন পরিপূর্ণ।

“মানুষদের মধ্যে তুমি সর্বোৎকৃষ্ট, গানে ও ঋক্‌-স্তবকে”—এই ঋক্ স্তবই হল দিন, যা ঋক্‌-রূপে পরিপূর্ণ।

যে প্রথম পদে অক্ষর সংখ্যা কম, সেই পদে সে অবস্থান করে। ‘কমে’—মানে, যেখানে বীজসঞ্চার ঘটে, সেখানে কমে যায়; কমতেই প্রাণ, কমতেই খাদ্য সমবেত হয়। এই সকল কামনাসমূহের নিয়ন্ত্রণসাধনের জন্য এই জ্ঞান হয়—যে ব্যক্তি এইরূপে জানে, সে এই কামনাসমূহকে আয়ত্ত করে।

দুই পদ বিশিষ্ট দশ অক্ষরের স্তোত্র হয়—উভয় খাদ্য ও খাদ্যগ্রহণের প্রাপ্তির জন্য।

এবং যা দ্বিপদী, আর যা চতুষ্পদী, এইভাবে অষ্টাদশ, অর্থাৎ আঠারো অক্ষরের স্তোত্র হয়।

এই দশটি হল—নব প্রাণ, আত্মা দশম। আত্মারই এই সংস্কৃতি।

এই আটটি—অর্থাৎ অষ্টকবিধ কামনা—উদিত হয় এবং লাভ করা যায়, যা কিছু কামনা করা হয়—এই জ্ঞান যার আছে, সে তা লাভ করে।

সে (ঋষি) নদীর মতো আচরণ করে, কারণ প্রাণই হল নদী। এইজন্য, যখন প্রাণ ধ্বনি তোলে, তখন সবকিছু যেন সেই ধ্বনির সঙ্গে মিলিত হয়। “নদী হল ওদতীদের অধিষ্ঠান”—এই বাক্য উষ্ণিক ছন্দে উচ্চারিত হয়; এর পরবর্তী অংশ অনুষ্টুপ ছন্দে। উষ্ণিক ছন্দই জীবন, আর বাকই অনুষ্টুপ। এই দুই ছন্দে সে জীবন এবং বাক ধারণ করে।

এই স্তব তিনবার উচ্চারিত হয়; প্রথমবারে তা পঁচিশ পদযুক্ত হয়। আত্মাও পঁচিশ, প্রজাপতিও পঁচিশ। দশটি হস্তের আঙুল, দশটি পায়ের আঙুল, দুইটি উরু, বাক্ ও আত্মা—এইসব মিলিয়ে আত্মাই পঁচিশ সংখ্যক হয়ে ওঠে। এইভাবে সে পঁচিশ সংখ্যক আত্মাকে শোধন করে। আর এই ‘অহঃ’ বা দিবসটিও পঁচিশ অঙ্গবিশিষ্ট, এই কারণে দিনের স্তোমও পঁচিশ পর্বে বিভক্ত। এইভাবে পঁচিশ সংখ্যার সঙ্গে সাম্য স্থাপন হয়। এইজন্য এই সংখ্যা পঁচিশ হয়ে থাকে—এটাই আত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে পঁচিশের অর্থ।

এবার দেবতাময় দৃষ্টিভঙ্গি: চক্ষু, কর্ণ, মন, বাক্ ও প্রাণ—এই পাঁচটি হল দেবতা। এরা এই দেহকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে প্রবিষ্ট করে; এই দেহই যেন ওই পাঁচ দেবতার দ্বারা পূর্ণ। এই দেহে লোম থেকে নখ পর্যন্ত সমস্ত অংশেই দেবতা বিদ্যমান। এইজন্য সমস্ত জীব, এমনকি পিঁপড়ের মতো ক্ষুদ্র প্রাণীও যেন দেবতাময় দেহ থেকেই উৎপন্ন হয়।

এইভাবেই ঋষি এই সত্য বলেছেন:

“সাহস্রধা পঞ্চদশান্যুক্তি”—পাঁচটি হচ্ছে দশ থেকে।
যতদূর আকাশ ও পৃথিবী বিস্তৃত, ততটাই এই সত্যও বিস্তৃত।
যত বড় আকাশ ও পৃথিবী, ততটাই আত্মার মহিমা।
“সাহস্রধা মহিমানঃ সাহস্রম্”—এই উক্তিগুলি ঐতিহাসিক স্তোত্রসমূহই, যা আনন্দ দেয় ও গৌরব বৃদ্ধি করে।
যতদূর ব্রহ্মা বিস্তৃত, ততটাই বাক বিস্তৃত। যেখানে বাক, সেখানেই ব্রহ্ম—আর যেখানে ব্রহ্ম, সেখানেই বাক। এইভাবে এই সত্যই প্রতিপন্ন হয়।

এই ঋচাগুলির মধ্যে প্রথম স্তবটি নয়টি ঋচযুক্ত, এবং প্রাণের জন্য উৎসর্গিত; কারণ প্রাণও নয়।
তারপর ষড়্ঋচযুক্ত একটি স্তব, যা ঋতুগুলির লাভের জন্য; কারণ ঋতুও ছয়।
পাঁচটি ঋচবিশিষ্ট একটি স্তব আছে, যা পঙ্‌ক্তিরূপ—পঙ্‌ক্তিই হল অন্ন, আর অন্নই অনাদি (ভোজনযোগ্য)।
আর একটি তিন ঋচবিশিষ্ট স্তব আছে, যা তিনটি লোককে জয় করার জন্য। এই তিন লোক—ভূঃ, ভূবঃ, স্বঃ।

এইসব স্তবই একত্রিত হয়ে বৃহতী ছন্দে পরিণত হয়।
বৃহতী ছন্দই অমৃত, দেবলোক। এই আত্মাই এই বৃহতীতে প্রবেশ করে।
এভাবেই, যে এই সমস্ত উপলব্ধিতে আত্মাকে অবগাহন করে, সে অমৃতের সঙ্গে ঐক্যলাভ করে।

এইভাবেই ঐতরেয় ব্রাহ্মণ-এর আরণ্যক-কাণ্ডের প্রথম আরণ্যকের তৃতীয় অধ্যায়ের অষ্টম খণ্ড শেষ।
এইভাবেই বহ্বৃচ ব্রাহ্মণ আরণ্যক-কাণ্ডের প্রথম আরণ্যকের তৃতীয় অধ্যায় সমাপ্ত। ।। ৩ ।।

এতঃপর প্রথমারণ্যকের চতুর্থ অধ্যায় ১.৪.১

এবার বলা হচ্ছে— সূদদোহ। প্রাণই সূদদোহ। প্রাণের দ্বারাই সে (ঋষি) পর্বগুলিকে সংযুক্ত করে, এইভাবে বলা হয়েছে।

এরপর বলা হয়েছে— গ্রীবাকে (গলা) বলা হয় ঊষ্ণিহ্ ছন্দের অনুকরণে; অর্থাৎ গলা হল ছন্দসমূহের ঊষ্ণিহ্।

পুনরায় বলা হয়েছে— প্রাণই সূদদোহ। প্রাণের দ্বারাই ঋতুসমূহকে পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত করে।

এরপর বলা হয়েছে— মস্তক (শির) গায়ত্রী ছন্দের মধ্যে বর্তমান হয়। ছন্দসমূহের মধ্যে গায়ত্রী সর্বাগ্রে, অঙ্গসমূহের মধ্যে মস্তক সর্বাগ্রে। সেই জন্য তা ‘অগ্র’ (শ্রেষ্ঠ) বলা হয়।

পুনরায় বলা হয়েছে— গায়ত্রী ছন্দটি অর্কবতী (যজ্ঞের স্তোত্রযুক্ত)। অগ্নিই অর্ক। এগুলি (অর্থাৎ অর্কগুলি) নয়টি হয়। নয় কপাল বিশিষ্ট মস্তকও নয়টি ভাগে বিভক্ত।

দশমটি ‘শংসতি’— অর্থাৎ চর্ম ও চুল। এটি ‘শংসন’রূপেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

অতএব দুইটি স্তোম (ত্রিভৃত্ স্তোম) ও ছন্দ (গায়ত্রী ছন্দ) হয়। এই দুই— স্তোম ও ছন্দের দ্বারাই সমস্ত সৃষ্টি উৎপন্ন হয়। যা কিছু এই জগতে সৃষ্টি হয়েছে, তা এই স্তোম ও ছন্দের মাধ্যমেই জন্ম নিয়েছে— এইভাবে বলা হয়েছে।

যে ব্যক্তি এইভাবে জানে, সে প্রজা ও পশু দ্বারা সমৃদ্ধ হয়।

পুনরায় বলা হয়েছে— প্রাণই সূদদোহ। প্রাণের দ্বারাই ঋতুগুলিকে (পর্বসমূহকে) সংযুক্ত করে।

এরপর বলা হয়েছে— ‘বিজবস্তা’— অর্থাৎ যেটি ‘বিরাট্’ তা ‘বিজ’ (বিজয়ী) হয়। এজন্য পুরুষ অপর পুরুষকে বলে— “তুমি আমাদের মধ্যে বিরাট্, তুমি গ্রীবা বহন করো।”

‘স্তম্ভমান’ বা ‘গর্বিতভাবে উত্তোলিত’ হওয়া মানে— যে দ্রুত ও সুসজ্জিতভাবে অন্ন গ্রহণ করে, এবং ফিরে আসে— কারণ অন্নই হচ্ছে বিরাট্, অন্নই হচ্ছে বীর্য।

অতএব আবার বলা হয়েছে— প্রাণই সূদদোহ, প্রাণের দ্বারাই ঋতুগুলিকে সংযুক্ত করে।

১.৪.২

এবার দক্ষিণ পক্ষ (অর্থাৎ দক্ষিণ দিক বা যজ্ঞের দক্ষিণ অংশ) ব্যাখ্যা করা হলো। এই বর্তমান লোকই দক্ষিণ দিক; এই লোকই হলো অগ্নি। বাক্ (বাকশক্তি) এই অংশের প্রতিনিধিত্ব করে, এবং রথন্ত্র (একটি সামগান) এর সঙ্গে যুক্ত; তার সঙ্গে যুক্ত ঋষি হলেন বসিষ্ঠ। এই অংশে শতটি স্তব বা সামগান থাকে, যেগুলো ছয়টি ‘বীর্য’ (প্রভাবশালী শক্তি) ধারণ করে। এই অংশ কাম (ইচ্ছা), প্রতিষ্ঠা ও অন্নাদ্য (খাদ্য ও ভক্ষণক্ষমতা) লাভের উদ্দেশ্যে প্রয়োগযোগ্য। তাই এ অংশে পঙক্তি স্তব ব্যবহৃত হয়।

এবার উত্তর পক্ষ (অর্থাৎ উত্তর দিক বা যজ্ঞের উত্তর অংশ) ব্যাখ্যা করা হলো। এই দিক হচ্ছে সূর্যের দিক, মানস (মন) এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এবং এর সঙ্গে যুক্ত সামগান হল বৃহৎ, এবং ঋষি হলেন ভরদ্বাজ। এখানেও শতটি স্তব বা সামগান থাকে, যেগুলো ছয়টি বীর্য ধারণ করে এবং কামলাভ, প্রতিষ্ঠা ও অন্নাদ্যের উদ্দেশ্য সাধন করে।

এ দুটি পক্ষের মধ্যে একটিকে অধিক এবং অন্যটিকে অনধিক বলা হয়—বৃহৎ (পুরুষসুলভ সামগান) অধিক এবং রথন্ত্র (নারীসুলভ সামগান) অনধিক। অতএব, একটিকে পুরুষের জন্য আর অন্যটিকে নারীর জন্য বলা হয়।

এই দুই পক্ষেই ‘উপর ও নিচ’ এর মতো পার্থক্য আছে—যেমন এক পাখির (সুপর্ণ) ডান ও বাম ডানা। একমাত্র পুত্রের মাধ্যমেই সেই ‘উত্তর পক্ষ’ শ্রেষ্ঠ হয়; এইজন্য উত্তর দিকের স্তোত্র একচরণেই শ্রেষ্ঠ হয়।

এরপর পুনরায় বলা হচ্ছে—‘প্রাণই হল সূদদোহা (যে প্রাণ সকল যজ্ঞ পর্বকে সংযুক্ত করে)’।

এবার বলা হচ্ছে: ‘পুচ্ছ’ (লেজের) ব্যাখ্যা। এতে ২১টি দ্বিপদ উপাদান আছে—যেমন সুপর্ণ পাখির ২১টি পালক থাকে। একবিংশ স্তোম (স্তব) হল সমস্ত স্তোম বা স্তোত্রগুচ্ছের প্রতিষ্ঠা। তাই লেজ (পুচ্ছ) হল বয়স ও প্রতিষ্ঠার প্রতীক।

২য় স্তোমে এই প্রতিষ্ঠা স্তব করা হয়। সমস্ত জীবের পেছনের দিক (পুচ্ছ বা ভিত্তি) থেকেই তাদের স্থিরতা আসে, প্রতিষ্ঠা সেখান থেকেই হয় এবং তার থেকেই তারা উদ্ভূত হয়। তাই পুচ্ছই প্রতিষ্ঠা।

এইভাবেই এই মানুষ (পুরুষ), দুইটি দশশক্তি বিশিষ্ট বৃহৎ শক্তি দ্বারা স্থিত। তার ‘সুপর্ণরূপ’ অংশ কামপূর্তির জন্য আর তার ‘মানবরূপ’ অংশ সম্মান, খ্যাতি, খাদ্য ও পূজার উদ্দেশ্যে হয়।

পরিশেষে বলা হচ্ছে:
“সূদদোহা হল পুরুষ (বৃষ) আর ধায়্যা (যা গর্ভধারণ করে) হল স্ত্রী (যোষা)।”
এই দুই থেকে মিলনে যে বীজসঞ্চার হয়, তা একাত্ম হয়ে যায় এবং গর্ভ ধারণ হয়। কারণ সন্তানধারণ নারীর মধ্যেই ঘটে। তাই এই প্রসঙ্গটি নারীকেই উৎসর্গ করা হয়েছে।

১.৪.৩

গায়ত্রী ছন্দে ত্রিচাশীতিসংখ্যক স্তোত্র পাঠ করা হয়। এই পৃথিবীই গায়ত্রী, গায়ত্রীর সেই ত্রিচাশীতি স্তোত্রসমূহ এই জগতেই আছে। এই জগতে যশ, মহত্ত্ব, দাম্পত্য, অন্নাদি ও শ্রদ্ধা— এইসব কিছু সেই গায়ত্রীর মধ্যেই প্রাপ্ত হয়। গায়ত্রী স্তোত্র পাঠ করে এই জিনিসগুলো অর্জন করা যায়, সেই শক্তি, ঐশ্বর্য ও ভোগ্যসম্পত্তি লাভ করা যায়, সেগুলির রক্ষণ হয় এবং এই উদ্দেশ্যেই পাঠক বলে:
“তন্মে অসৎ”— অর্থাৎ, এইগুলি যেন আমার জন্য কল্যাণকর হয়।

এর পর আবার বলা হয়েছে—
“অথ সূদদোহাঃ”
সূদদোহ (দুগ্ধদাত্রী গাভী) হল প্রাণ; এই প্রাণ-শক্তির দ্বারাই এই লোক (পৃথিবী) রক্ষা হয়।

এর পরে বার্হতী ছন্দে ত্রিচাশীতিসংখ্যক স্তোত্র পাঠ করা হয়। মধ্যলোক (অন্তরীক্ষ) বার্হতী ছন্দের অধীন। এই মধ্যলোকেও যশ, মহত্ত্ব, দাম্পত্য, অন্নাদি, শ্রদ্ধা ইত্যাদি— সবই সেই বার্হতী ছন্দের অন্তর্ভুক্ত। পাঠক তা অর্জন করেন, তা ধারণ করেন, তা রক্ষা করেন, এবং বলেন—
“তন্মে অসৎ”— এটা যেন আমার কল্যাণে লাগে।

পুনরায়,
“অথ সূদদোহাঃ”
— সূদদোহ (গাভী) প্রাণস্বরূপ; প্রাণ-শক্তির দ্বারাই এই অন্তরীক্ষলোক রক্ষা পায়।

এর পরে ঔষ্ণিহী ছন্দে ত্রিচাশীতিসংখ্যক স্তোত্র পাঠ করা হয়। ঊর্ধ্বলোক (দ্যুলোক) হল ঔষ্ণিহী ছন্দের অন্তর্গত। ঊর্ধ্বলোকে যশ, মহত্ত্ব, দাম্পত্য, অন্নাদি, শ্রদ্ধা এবং দেবতাদের ঐশ্বর্য— সবই এই ঔষ্ণিহী স্তোত্রের মাধ্যমে অর্জিত হয়।

পাঠক বলেন—
“তন্মে অসৎ”— এটা যেন আমার কল্যাণে পরিণত হয়।

এখানেও বলা হয়েছে,
“অথ সূদদোহাঃ”
— সূদদোহ, অর্থাৎ প্রাণ, এই ঊর্ধ্বলোককেও রক্ষা করে, সংরক্ষণ করে।

এই খণ্ডে বলা হয়েছে— তিনটি স্তরে (ভূঃ, ভুবঃ, স্বঃ) গায়ত্রী, বার্হতী ও ঔষ্ণিহী ছন্দে ত্রিচাশীতিস্তোত্র পাঠের মাধ্যমে পৃথক পৃথকভাবে যশ, মহত্ত্ব, দাম্পত্য, অন্নাদি ও শ্রদ্ধার প্রাপ্তি হয়। প্রাণ এই তিনটি লোককেই ধারণ করে ও রক্ষা করে। এবং পাঠকের উদ্দেশ্য— এই সকল সম্পদ যেন তার কল্যাণে, প্রতিষ্ঠায় ও প্রাপ্তিতে সহায়ক হয়— এই প্রত্যাশা নিয়েই সে পাঠ করে— “তন্মে অসৎ”।

১.৫.১

বশ” মন্ত্র উচ্চারণ করা হয়—
বশে ম ইদং সর্বমসদিতি”—
অর্থাৎ, এই সমস্তই যেন আমার বশে থাকে, যেন সমস্ত জগৎ আমার অধীন হয়, এই প্রার্থনা করা হয়।

এই “তা” (মানে ছন্দ বা স্তোত্র) একবিংশতি (২১) সংখ্যক হয়,
কারণ সেই একবিংশতি অন্তঃউদর (শরীরের ভিতরের) বিকৃতিরূপে বিবেচিত হয়।

আর, একবিংশ (২১) সংখ্যক স্তোম (সামগানের বিশেষ রূপ) গুলির মধ্যে প্রতিষ্ঠা থাকে।
প্রতিষ্ঠাই হল অন্তরের আহার্য্য, অর্থাৎ যা আত্মার পুষ্টি দেয়।

এই “তা” (স্তোত্রগুলি) বিচ্ছন্দসো হয়—
অর্থাৎ, তারা যেন নানা রকম ছন্দে রচিত,
ঠিক যেমন বিক্ষিপ্ত শস্যক্ষেত্রের মধ্যে বিভিন্ন আকারের দানা থাকে—
কখনো ছোট, কখনো বড়, কখনো মাঝারি।

এই সব স্তোত্রে প্রণব (ওঁ) ও ছন্দের আকার অনুযায়ী উচ্চারণ করা হয়,
ছন্দের সংগতি অনুযায়ী কখনো তা ছোট হয়, আবার কখনো লম্বা।

এরপরে আসে সূদদোহা মন্ত্র,
যেখানে বলা হয়েছে—
প্রাণ-ই হল সূদদোহা,
কারণ প্রাণই পার্বণ উৎসবগুলিকে সংহত করে বা রক্ষা করে।

এই “তা” (স্তোত্রসমূহ) এখানে (বেদিয়ায়) উৎসর্জন করা হয়—
দ্বাদশবার শংসন (আশীর্বাদ) দিয়ে।

এই দ্বাদশবিধ প্রাণরূপ—
যার মধ্যে সাতটি শীর্ষস্থ (মস্তিষ্কসঙ্গী),
দুইটি স্তন্য (স্তন),
তিনটি অধোগামী (নিম্নস্থিত)।

এইসব প্রাণ এখানে (এই শরীরে) আগত হয়,
এবং এখানেই পরিশোধিত হয়,
এই কারণে এই “তা” সমূহকে এখানে উৎসর্জন করা হয়।

এরপর “ইন্দ্রাগ্নী যুবং সু ন” এই মন্ত্র উচ্চারিত হয়—
এটি হল ঐন্দ্রাগ্ন স্তোত্র,
যার দ্বারা দুইটি উরুউরুঃস্থিভ (উরুর হাড়) প্রতিষ্টিত হয়।

এই স্তোত্রগুলি ষট্‌পদী হয়—
কারণ প্রতিষ্ঠার মধ্যে দ্বিগুণ সংখ্যা প্রয়োজন—
পুরুষ দ্বিপদ (দুই পায়ে চলে),
পশুরা চতুষ্পদ (চার পায়ে চলে)।

এইভাবে যজমানকে দ্বিপদচতুষ্পদ পশুদের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করা হয়।

এরপর দ্বিতীয় স্তোত্র সাতপদী হয়,
এতে গায়ত্রীঅনুষ্টুপ ছন্দ ব্যবহৃত হয়—
গায়ত্রী হল ব্রহ্ম,
অনুষ্টুপ হল বাক্ (বাকশক্তি)।
এই দ্বারা ব্রহ্ম এবং বাক্‌কে একত্র সংযুক্ত করা হয়।

শেষে ত্রিষ্টুপ ছন্দে স্তোত্র বলা হয়—
ত্রিষ্টুপ ছন্দের দ্বারা বীর্য (শক্তি) প্রাপ্ত হয়,
এই শক্তির দ্বারাই যজমান পশুদের রক্ষাপরিচালনা করেন।
এই কারণেই পশুগণ বলবান ও গমনক্ষম হয়।

১.৫.২

“प्र वो महे मन्दमानायान्धस” — এই মন্ত্রটি ইন্দ্র-নিষ্কেবল্য স্তোমে গাওয়া হয় এবং এতে ত্রিষ্টুপ ও জগতী ছন্দ ব্যবহৃত হয়। এক ঋষি প্রশ্ন করেন, কেন নিৱিদ্ (গোপন স্তব বা স্তবক) এই ত্রিষ্টুপ ও জগতী ছন্দের মধ্যেই রাখা হয়? এর উত্তর দেওয়া হয়: এই ছন্দগুলির কোনও একটিতেও নিৱিদ্ স্বতন্ত্রভাবে এক দিনে ধারণ করা যায় না; সুতরাং, নিৱিদ্-কে ত্রিষ্টুপ ও জগতীর মধ্যে স্থাপন করা হয়।

এখানে একটি গূঢ় বিধান দেওয়া হয়েছে: এটি “অহস্ত্রিনিৱিত্ক” (অর্থাৎ হাতে ধারণ করা যায় না এমন তিনরকম নিৱিদ্) নামক পরিচ্ছেদ বলে জানা উচিত। এর অন্তর্গত বিষয় হল— ‘বশ’ (নিয়ন্ত্রণ), ‘নিৱিদ্’, ‘বালখিল্য’ (গৌণ ঋষিদের ঋচ), এবং ‘নিৱিদ্-নিৱিদ্’ — এগুলো সব একত্রে ‘ত্রিনিৱিত্ক’ হিসেবে জ্ঞাত হওয়া উচিত।

পরবর্তী অংশে বর্ণিত হয় যে এক ঋষি—চাকন্য—বনের মধ্যে বসে প্রথম মানবসন্তান হিসেবে মনস্বী বাচনের দ্বারা সূক্ত রচনা করেন। এতে খাদ্যের (অন্ন) ও বুদ্ধির (মনীষা) মিলনের মাধ্যমে অন্নাদ্যের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হয়।

এরপর ‘আবপন’ (অর্থাৎ একটি আচার যেখানে দশটি ইন্দ্রীয়সম্পন্ন ত্রিষ্টুপ ও জগতী ছন্দে রচিত দশটি স্তব রচনা হয়) বিষয়ে বলা হয়, যার দ্বারা আয়ু দীর্ঘ হয়—যতগুলি স্তব আবৃত্তি করা হয়, ততগুলি বছর আয়ু বৃদ্ধি পায়।

“প্রজা মেঃ পশবঃ অর্জয়न्” — এই স্তবটি বললে সন্ততি ও পশুধন লাভ হয়।

তারপর বলা হয়, ‘তার্ক্ষ্য’ নামক দেবতা ‘স্বস্ত্যয়ন’—শুভযাত্রা—প্রতীক। তাই এই স্তব পাঠ করলে কল্যাণ হয়।

“একপদা শংসতি” — এই স্তব একচরণবিশিষ্ট সমস্ত কিছু সন্নিবেশ করে বলে গণ্য হয় এবং ছন্দসমূহের পূর্ণতা অর্জিত হয়।

এরপর “ইন্দ্রং বিশ্বা অবীবৃধন্ন্” স্তবটি সাতবার পাঠ করা হয়; এটি সাতটি মূল প্রানের প্রতিনিধিত্ব করে এবং প্রানসমূহের মধ্যে স্থাপন করা হয়। অষ্টম স্তবটি পাঠ করা হয় না কারণ সেটি বাকের প্রতীক, এবং বাগ্বলে প্রান সংযুক্ত না থাকলে বাক্য শক্তিশালী হয় না। অতএব বাক সংযুক্ত হলেও তা প্রান ছাড়া অনুরূপ শক্তিশালী হয় না।

“বিরাট্” স্তবটি খাদ্যরূপে গৃহীত হয় — খাদ্য ও ভোগ্যবস্তুর সুরক্ষার জন্য। আবার “ইন্দ্রং বিশ্বা…” স্তবটি পুনরাবৃত্তি হয় প্রানের প্রতিষ্ঠার জন্য।

এরপর ‘বাসিষ্ঠ’ স্তব — “বাসিষ্ঠেন পরিদধাতি” — যেখানে বাসিষ্ঠ নামক ঋষি নিজেই মুখ্য গায়ক।

“এষ স্তোমো মহ উগ্রায় বাহ” — এই স্তব ‘মহত্ত্ব’ এবং ‘রূপ-সম্পদ’ বৃদ্ধির প্রতীক।

“ধুরি বাত্যো না বাজয়ন্নধায়ী” — এই স্তব দিনের ‘ধূর’ (অগ্রভাগ) অংশে উচ্চারিত হয়; এতে দিনের গঠনের প্রতীক প্রকাশ পায়।

“ইন্দ্র ত্বায়মর্ক ঈট্টে বসুনাম্” — এই স্তব আর্কবতী রীতিতে উচ্চারিত হয় রূপ-সম্পদ বৃদ্ধির জন্য।

“দিভীব দ্যামধি নঃ শ্রমতং ধা” — যেখানে কেবল ব্রাহ্মণ বাক্য উচ্চারিত হয়, সেখানেই খ্যাতি স্থাপিত হয়। তাই জ্ঞানী ব্যক্তি এইভাবে স্তব রচনা ও পাঠ করেন, এবং তাকেই অনুসরণ করা উচিত।

১.৫.৩

“তৎ সৱিতুর্ বৃণীমহে…” — এই মন্ত্রটি বৈশ্বদেব সূক্তের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত; এর দুটি রূপ রয়েছে—প্রতিপদ এবং অনুচর, এবং উভয়েই একাহিক (একদিনের) যজ্ঞে রূপসিদ্ধির জন্য উচ্চারিত হয়। এই দিনে বহু কিছু শাস্তিপূর্ণ উপায়ে আয়োজিত হয়; এই শান্তিই প্রকৃত প্রতিষ্ঠা। একাহিক যজ্ঞ শান্তির মধ্য দিয়েই প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং শেষে এই শান্তিতেই স্থিতি লাভ করে—এই কথা যিনি জানেন, এবং যাঁদের জন্য এই জ্ঞানী হোতা মন্ত্র পাঠ করেন, তাঁদেরই কল্যাণ ঘটে।

“তৎ দেবস্য সৱিতুর্ বার্যং মহৎ…” — এই ‘সাবিত্রী’ মন্ত্র একটি ‘মহৎ’ (বিশালতাযুক্ত) সূক্ত; এটি সেই দিনেরই এক বিশেষ রূপ। তখন প্রশ্ন ওঠে—কে পূর্ববর্তী, কে পরবর্তী? তখন বলা হয় যে দ্যুলোক ও পৃথিবীসমূহ একসাথে সূর্যোদয়ের ন্যায় একই সাথে উদিত হয়—এই সময়ের এইটাই বিশেষ রূপ।

“অনশ্বো জাতো অনভীশুরুক্ত্য” — এইটি ‘আর্বব’ সূক্ত, যা ধ্যানার্থ।
“রথস্ত্রিচক্র” — এর দ্বারা পদ ও ত্রিবৃত্ স্তোত্র বোঝানো হয়েছে; এটি একটি ত্রিবৃত্ স্তোত্র, সেই দিনেরই একটি রূপ।
“অস্য বামস্য পলিতস্য হতুঃ” — এটি একটি বৈশ্বদেব সূক্ত, যা বহু রূপে প্রকাশিত।

“গৌরীর্মিমায় সলিলানি তক্ষতী” — এইটি সেই স্তোত্রের অন্ত।
“আ নো ভদ্রাঃ ক্রতবঃ যন্তু বিশ্বতঃ” — এই বৈশ্বদেব মন্ত্র একটি নিবিদ্ধান (সংযুক্ত) একাহিক রূপসিদ্ধ স্তোত্র। এখানে আবার বলা হয়েছে যে এই দিনের মধ্যে নানা ‘বারণ’ (নিরোধ/নিয়ন্ত্রণ) পালন করা হয়; শান্তিই প্রতিষ্ঠা, এবং শান্তিতেই শেষে স্থিতি আসে—যিনি এভাবে জানেন এবং যাঁদের জন্য এই হোতা পাঠ করেন, তাদের কল্যাণ হয়।

“বৈশ্বানরায় ধিষণামৃতাবৃধে” — এটি অগ্নি ও বায়ুর সম্মিলিত সূক্তের প্রারম্ভিক অংশ, যার ‘ধিষণা’ (বুদ্ধি) হল সূক্তের শেষাংশ—এই দিনেরই একটি রূপ।

“প্র যজ্যবো মরুতো ভ্রাজদৃষ্টয়” — এইটি মারুত সূক্ত, যা একত্রে উদিত বা সমানভাবে প্রকাশিত—এই দিনেরই আরেকটি রূপ।

“জাতবেদসে সুনবাম সোমম্” — এই মন্ত্র জাতবেদ (অগ্নি) দেবতার জন্য উৎসর্গিত; এটি সূক্তের শুরুতে বলা হয় এবং কল্যাণের জন্য স্বস্ত্যয়ন হিসাবে ব্যবহৃত হয়। জাতবেদ হ’ল স্বস্তির জন্যই। এইভাবে এই মন্ত্র কল্যাণের উদ্দেশ্যে উচ্চারিত হয়।

“ইমং স্তোমমর্ঘতে জাতবেদস” — এই জাতবেদ সূক্ত সমানভাবে উদিত হয়—এই দিনের একটি বিশেষ রূপ।

এইভাবে ঐতরেয় আরণ্যকের প্রথম আরণ্যক, পঞ্চম অধ্যায়ের সমাপ্তি হয়।

এই খণ্ডে আরণ্যকের স্তোত্রগুলিকে বৈশ্বদেব, সাবিত্রী, মারুত, জাতবেদ ইত্যাদি দেবতাদের সঙ্গে সংযুক্ত করে যজ্ঞীয় প্রয়োগ ও তার আধ্যাত্মিক তাৎপর্য ব্যাখ্যা করা হয়েছে। প্রতিটি সূক্ত বা স্তোত্র একদিনের যজ্ঞের বিভিন্ন দিক, রূপ, ও প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। শান্তি এবং কল্যাণ এই স্তোত্রগুলোর মূল লক্ষ্য। যিনি এইভাবে জানেন এবং যথাযথভাবে যজ্ঞ সম্পাদন করেন, তাঁরাই কল্যাণ প্রাপ্ত হন বলে ঘোষিত হয়েছে।

বাংলা অনুবাদ: তন্ময় ভট্টাচার্য (অ্যাডভোকেট)


Leave a Reply